“রাস্তায় যত্রতত্র শিক্ষার্থি এবং জনগনের হাতে রড, লাঠি, বাঁশের লাঠি প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা অনতিবিলম্বে প্রয়োজন”
ম্যাক হক, শিল্পী লেখক ও গবেষক
গুজবের রাজধানী
আমাদের আগাম পূর্বাভাস অনুযায়ী, ১৫ আগস্টের কর্মসূচি হবে ৩২ নম্বর সড়কে ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার পুড়িয়ে দেয়া শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাসভবনে। যেখানে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে সহ পরিবারে সবাই খুন হন। ১৪ আগস্ট, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সম্ভাব্য “পাল্টা-অভ্যুত্থান” বা “পাল্টা-বিপ্লব” নিয়ে দিনভর ভয় ও গুজব ছড়িয়ে পড়ে। গুজব ছিল যে সারা বাংলাদেশ থেকে ৩০ লক্ষ আওয়ামী লীগ ক্যাডার ঢাকার চারপাশে জড়ো হয় এবং শোক দিবসের সাথে মিল রেখে হামলার প্রস্তুতি নেয়। দিনটি পূর্বে একটি ছুটির দিন ছিল, যা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গত ১৩ আগস্ট বাতিল ঘোষণা করে। দিনটিকে “জাতীয় দিবস” বলে বর্তমানে আর কোনো ছুটির ঘোষণা নেই।
প্রতিরোধ সপ্তাহ
৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার নেতৃত্বদানকারী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা বর্তমানের তথাকথিত অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের বিরুদ্ধে সমস্ত হুমকি মোকাবেলা এবং এই আন্দোলনে নিহতদের হত্যার বিচার চেয়ে একটি “প্রতিরোধ সপ্তাহ” বা “রেজিসটেন্স উইক” নামে আরেকটি আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রথমদিন শাহবাগে সমবেত হয়ে সারারাত জাগরনের মাধ্যমে এটি শুরু হয়। কিন্তু, মজার ব্যাপার হলো, এটি ছিলো দৃশ্যত, ছাত্র আন্দোলনের সাথে জোটবদ্ধ সকল শক্তির একটা সম্মিলন, যেখানে স্পষ্টতই বিএনপি ও জামায়াতের পরিচিতিমূলক বৈশিষ্ট্য বর্তমান ছিলো।
প্রথম দিনে শাহবাগে সমবেত হয়ে সারারাত জাগরনের মধ্য দিয়ে এটি শুরু হয়। কিন্তু, মজার ব্যাপার হল, এটা স্পষ্টতই ছাত্র আন্দোলনের সাথে জোটবদ্ধ সকল শক্তির একটা সম্মিলন, যেখানে স্পষ্টভাবে বিএনপি ও জামায়াতের উপস্থিত ছিলো।
এবং অবাক করা বিষয় হল, সিআইএ কর্তৃক সমর্থিত ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা উত্তেজনা মূলক বক্তৃতা রাখে, তাদের বেশভূষা কিন্তু সরাসরি তালেবানি ইসলামী বেশ ছিলোনা! বরং, সুকৌশলে, পুরো ক্লিনশেভড, পরিপাটি গ্রুমড করা চুল, কেতাদুরস্ত পোশাকে। নিজেদের উপস্থাপন করে -ঠিক যেন, ৯/১১ এর সুকৌশলী শান্ত ছিনতাইকারীদের মত।
আগুনে ঘি ঢালা
ইতোমধ্যেই আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ হাসিনা দিল্লীতে অবস্থানরত, ১৫ আগস্ট সকালে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মীরা এবং দেশপ্রেমিক জনসাধারনকে শোক দিবসে শ্রদ্ধা জানানোর আহ্বান জানালে পরিস্থিতি জটিলাকার ধারন করে।
তাঁর এ আহ্বানে সারা দিয়ে আওয়ামীলীগ নেতাকর্মী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে, বিক্ষুব্ধ ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের কাছে তুমুল হামলা ও বাধার মুখে পড়েন।
সেনাবাহিনীর সদস্যদের পিছনের সারিতে ক্ষুরধার ব্যারিয়ারে নীরব দর্শকের ভূমিকা রাখে, ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরা, কু ক্লাক্স ক্ল্যান-সদৃশ ন্যায় কর্মীদের ছদ্মবেশে, সন্দেহাতীত শোককারীদের উপর হামলা ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। পরে সেই অনাচার ও আক্রমণ বাক স্বাধীনতার ওপর অবিশ্বাস্য আক্রমণে রূপ নেয়।
মাত্রাতিরিক্ত আচরনের শিকার ভিকটিমগন
জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী এবং আওয়ামীলীগ কর্মী রোকেয়া প্রাচী ১৪ আগস্ট সন্ধাবেলা আরো দলীয় কর্মিদের নিয়ে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করতে গেলে তাঁকে নির্মমভাবে সেখানে প্রহার করা হয় বলে একটি টিভি চ্যানেলকে তিনি জানিয়েছিলেন।
যদিও এ সংক্রান্ত কোনো ভিডিও ফুটেজ গ্রহণ করতে দেয়া হয়নি এবং তাঁর হাসপাতালে চিকিৎসা নেবার বিষয়টিও আর জানা যায়নি। অপর দিকে ১৯৭১ এর গেরিলা নেতা কাদের সিদ্দিকীকেও শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি পরদিন ১৫ আগস্ট শ্রদ্ধা জানাতে গেলে, বর্বরতার সম্মুখিন হতে হয়েছে।
তাঁকে ক্রুদ্ধ আক্রমণাত্মক ভাষায় বাধা দিয়ে, ফিরে যেতে বলা হয়েছে এবং এক পর্যায়ে তাঁকে বহনকারী গাড়িটিতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করা হয় । আরও দেখা গেছে শ্রদ্ধা জানাতে আসা একজন ভদ্রলোককে বিবস্ত্র করে প্যারেড করাতে বাধ্য করা হয়েছে।
নেটিজেনদের সবচে মর্মাহত এবং হতবাক করে দিয়েছে একজন নারীকে প্রহার এবং লাঞ্ছিত করা, দেশের প্রবীণ সম্মানিত নাগরিকদের এহেন নির্মমভাবে চূড়ান্ত বেয়াদবি ও অসম্মানিত এবং সেসব নির্যাতনের গ্রাফিক চিত্র যেগুলো নেটে ভেসে বেড়াচ্ছে, তাতে সবার প্রশ্ন, এগুলো কোন ধরণের মর্মান্তিক অপমান এবং বাক স্বাধীনতার উপর কেনো এই তুমুল বিদ্বষপূর্ণ হস্তক্ষেপ?
’লুঙ্গি ডান্স’ এবং এই দায় কার?
১৫ আগস্টের প্রাক্কালে ধানমণ্ডি ৩২ এর শেখ মুজিবুর রহমানের ভস্মিভূত বাড়ির সামনে কারা রাতভর “লুঙ্গি ড্যান্স” গানের সাথে উদ্দাম নৃত্য করেছে- এ প্রশ্নে যদিও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা নিজেদের সরাসরি জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে- কিন্তু তাদের নজরদারীতে থাকা এসব কর্মকান্ডের দায় তারা এড়াতে পারেনা।
প্রেস রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বিএনপি ও জামায়াত যৌথভাবে সে রাতে “দায়িত্ব পালনে” ছিলো এবং পুরোটা সময় এ জঘন্য আচরনের জন্য তাদেরকেই সবচে ঘৃন্য অপরাধি হিসেবে সাব্যস্ত করা যায়। খোলা আকাশে, মধ্যরাতে ৯০ মিনিটের ডিস্কো সেশনে পরিবেশিত হয় ভারতীয় সিনেমার বহুল জনপ্রিয় “লুঙ্গি ড্যান্স” গানটি, যেখানে তারাই আবার স্ব-স্বীকৃত ডানপন্থী “ভারত বিরোধী “boycott India” এর প্রচারক!
এবং তারপর?
ঘোষনা এসেছে, ১৮ আগস্ট থেকে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেবার। শিক্ষার্থিদের নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে যাবার অনুরোধ- বিশেষত সেনা কর্মকর্তা এবং অন্যান্যদের কাছ থেকে বার বার এসেছে, সেটা যদি আসলেই হয়, তাহলে এই কিছু শিক্ষার্থিদের অতি উৎসাহী, অশ্লীল, উগ্রতা একেবারে না হলেও কিছুটা কমে আসবে বলে আশা করা যায়।
সম্প্রতি আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের কর্তৃক জনৈক উপদেষ্টাকে দেয়া অতি জঘন্য, চূড়ান্ত আক্রমণাত্মক হুমকি “ আমরাই যাদের চেয়ারে বসিয়েছি, প্রয়োজন হলে আমরাই আসনচ্যুত করবো” বলে প্রবল হুমকি তথাকথিত ভীত অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের নড়বড়ে মেরুদন্ডে গিয়ে লেগেছে বলে মনে হয়।
ছাত্রদের এহেন অপরিপক্ক আচরনে সৃষ্ট অস্থিরতা উদ্বেগজনক এবং অতি জরুরীভাবে এর সমাধান করা প্রয়োজন। নতুবা, ভবিষ্যতে আরো ক্রমাগত বড় সহিংসতা ঘটার সমূহ সম্ভাবনা হ্রাস পাবার সম্ভাবনা নেই।
সুপারিশ
দেশের এই মুহূর্তে lনিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ যেই হোন না কেন, রাস্তায় যত্রতত্র শিক্ষার্থি এবং জনগনের হাতে রড, লাঠি, বাঁশের লাঠি প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা অনতিবিলম্বে প্রয়োজন। না হলে, নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে, বাদবাকি সাধারন জনগনকেও নিজেদের সুরক্ষার জন্য হাতে লাঠি বহনের অনুমতি দেয়া উচিত।
আত্মরক্ষা একটি মানবাধিকার। এবং গত ১৫ আগস্টে লাঠি হাতে আক্রমণের যে বিকারগ্রস্ত চিত্র আমরা দেখেছি, তাতে মনে হচ্ছে- আমরা দেশবাসী বর্তমানে একটি মারাত্মক টাইম বোমার উপর বসে আছি, যেটি পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হবার আশংকা আছে।