New York Bangla Life
বাংলাদেশবিশেষ প্রতিবেদন

নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি-জামায়াতের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে


আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে তিন সপ্তাহ যেতে না যেতেই রাজনীতিতে নাটকীয় সব ঘটনা ঘটছে। বিএনপি এরই মধ্যে নির্বাচন নিয়ে কোনো আওয়াজ না পেয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি হতাশা প্রকাশ করছে, অন্যদিকে নির্বাচন চাওয়ায় জামায়াতে ইসলামী বিএনপিকে ধুয়ে দিচ্ছে।

টানা চার দিন ধরে বিএনপি সরকারের কাছে নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করছে, অন্যদিকে জামায়াত বলছে, দেশ এখন বন্যায় ডুবছে, এই সময়ের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য না।

কেবল নির্বাচন নিয়ে দুই পক্ষ বিপরীত মেরুতে সেটাই নয়, জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান প্রকাশ্য আলোচনায় বিএনপিকে ‘দখলবাজ’ আখ্যা দিয়েছেন; বিএনপির সঙ্গে আর জোটে যাওয়া উচিত হবে কিনা, এ নিয়ে নেতাকর্মীদের কাছ থেকে মতামত চেয়েছেন, নেতাকর্মীরা সমস্বরে ‘না’ বলে তাদের মত তুলে ধরেছেন, তাতে সায় দিয়েছেন আমির নিজেও।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন থেকেই জামায়াতে ইসলামী দৃশ্যত সেনাবাহিনী ও সরকারের কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
আইনত জামায়াত এখন সন্ত্রাসী সত্তা হিসেবে নিষিদ্ধ সংগঠন। কিন্তু শেখ হাসিনা তুমুল গণ আন্দোলনের মুখে ভারত চলে যাওয়ার পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান যেসব দলকে সেনানিবাসে ডেকে নিয়ে বৈঠক করেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে জামায়াত।

বৈঠকে উপস্থিত একাধিক দলের নেতারা এমনটাও বলেছেন, সেই বৈঠকে সেনাপ্রধান জামায়াতের আমিরকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আপনার ছেলেদেরকে এখন ঘরে ফেরান।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেদিন বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশে ভাষণে এ নিয়ে কথা বলবেন, এমন কথাও তিনি সাংবাদিকদেরকে বলেন।

তবে ফখরুল যা যা বলেছিলেন, তার সবগুলোই রাষ্ট্রপতি বলেন, কেবল নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে একটি কথাও তিনি বলেননি।

৮ আগস্ট ইউনূস সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে তুমুল উৎসাহের সঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলের নেতারা যোগ দেন। চারদিন পর ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেছে দলটির প্রতিনিধি দল। সেদিন বের হয়ে ফখরুল বলেছেন, তারা নির্বাচন নিয়ে সরকারকে সময় দিতে চান।

কিন্তু ইউনূস সরকার সংস্কারের কথা বলে একের পর এক বদলি, চাকরিচ্যুতি আর পদোন্নতির আদেশ দিলেও সরকারের মেয়াদ নিয়ে কিছুই বলছে না। বরং এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে বিরক্তি প্রকাশ করছেন উপদেষ্টারা। এই অবস্থায় বিএনপি দৃশ্যত এই সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠছে।

মির্জা ফখরুলের ১৫ আগস্টের ভাষণটা ছিল ইঙ্গিতপূর্ণ। সেদিন তিনি বলেছিলেন, তারা এই সরকারকে ততদিন সমর্থন দেবেন, যতদিন তারা গণতন্ত্রের পক্ষে থাকবে।

এর মধ্যে ২৪ আগস্ট ফখরুল ছোটখাট একটা বোমা ফাটান। ঢাকায় এক আলোচনায় বলেন, “কয়েকজন ব্যক্তি একটা সংস্কার করে দিলেন এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাদের মাধ্যমে সেই সংস্কার আসতে হবে।”
সেদিন নির্বাচন প্রশ্নে তিনি বলেন, “সেটা (নির্বাচন) সীমিত সময়ের মধ্যেই করতে হবে, একটা যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই করতে হবে। তা না হলে যে উদ্দেশ্যে সেই উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যাহত হবে।”

অর্থাৎ ইউনূস সরকারের ভাবনায় যে নির্বাচন নেই, সেটি বিএনপি মহাসচিব এরই মধ্যে টের পেয়েছেন। টানা চার দিন একই কথা বলছে দলটি।

২৫ আগস্ট সিলেট গিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান সংস্কার করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময় সময় দিতে চাই, তবে এটি অনির্দিষ্টকালের জন্য নয়।,,,বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার মাত্র তিন মাসে সব জঞ্জাল দূর করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিয়েছিলেন।”

একই দিন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে ড. ইউনূস তার সরকার কী কী করতে চায়, তার বিস্তারিত কথা বলেন। কিন্তু নির্বাচন প্রশ্নে কোনো সুনির্দিষ্ট আলাপেই যাননি। তিনি বলেন, “কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন।”

দেশবাসী কীভাবে সময় ঠিক করবে, সেই প্রশ্নের মধ্যে পরদিন মির্জা ফখরুল বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘‘এখনও আমি ধোঁয়াশায়, যে অবস্থাটা সেটা আমার পরিষ্কার হয়নি। আমরা আশা করেছিলাম যে, প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়, তিনি একটা রোডম্যাপ দেবেন… সেই রোডম্যাপ আমরা কিন্তু ‘ট্রানজিশন টু ডেমোক্রেসি’, এটা আমরা কিন্তু উনার বক্তব্যের মধ্যে পাইনি।”


তার পরদিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ নির্বাচন নিয়ে অবস্থান স্পষ্ট করার তাগাদা দেন। তিনি বলেন, “একটি যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন দিয়ে জনগণের প্রতিনিধিদের দায়িত্বভার গ্রহণ করার সুযোগ করে দেন। রোডম্যাপ ঘোষণা করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।”

কিন্তু বিএনপি নির্বাচন নিয়ে তাগাদা দেওয়ায় দলটির তুমুল সমালোচনা করেছেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। ২৬ আগস্ট প্রকাশ্য আলোচনায় তিনি বিএনপির নাম উল্লেখ না করে বলেন, “একদিকে শহিদ পরিবারগুলো আহাজারি করছে, আহতরা হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন, ইতোমধ্যে বন্যার ভয়াবহতা শুরু হয়েছে। যারা জনগণের জন্য রাজনীতি করে না তাদের উচিত এ বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এ সময়টা ওখানে না দাঁড়িয়ে নির্বাচন নির্বাচন জিকির করলে জাতি এটাকে কবুল করবে?”

এটুক বলেই থামেননি জামায়াত আমির। তিনি দলের কর্মীদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, বিএনপির সঙ্গে তাদের আর জোটে যাওয়া উচিত হবে কি না। নেতাকর্মীরা সমন্বরে বলেন ‘না’।

এরপর নাম উল্লেখ না করেই বিএনপির বিরুদ্ধে দখলদারত্ব, লুটপাট ও চাঁদাবাজির অভিযোগ আনেন জামায়াত আমির।

তিনি বলেন, “তাদের তো নির্বাচন লাগেও না। ইতোমধ্যে তারা ফুটপাত থেকে শুরু করে সব দখলে নিয়েছে। যা আওয়ামী লীগ ১৫ বছরে সাজিয়েছিল, তার ৮০ ভাগ দখলে নিয়ে নিয়েছে।”

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশের পরিবহন ব্যবস্থা, বাজার ও সড়কে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ বিএনপির নেতাকর্মীদের হাতে চলে যাওয়ার তথ্য মিলেছে। জামায়াত তো বটেই, বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করা গণ অধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নূরও প্রকাশ্যেই বিএনপির নাম ধরে সমালোচনা করছেন।

বিএনপি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে তাদের দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ চাঁদাবাজি বা দখলদারি করলে যেন দলকে জানানো হয়। বেশ কয়েকজনের পদও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে দলের সাবেক মহাসচিব কে এম ওবায়দুল রহমানের মেয়ে শামা ওবায়েদও আছেন। আবার দলীয় পদ স্থগিত করে বিদেশি প্রতিনিধি দলের স্ঙ্গে বৈঠকে তাকে রেখেছেও বিএনপি।

বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্ক বরাবরই ছিল মধুর। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই গোলাম আযম পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে দেশে ফিরে আর ফেরত যাননি। খালেদা জিয়ার শাসনামলে গোলাম আযমকে জামায়াতের আমির ঘোষণা করা হয়। সেই আমলেই তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পান।

১৯৯০ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের অঘোষিত সমঝোতা ছিল। ২০০১ সালে দুই দল আনুষ্ঠানিক জোট করে। অনেক সমালোচনা ও দেশবিদেশের চাপেও সেই জোট ভাঙতে রাজি ছিল না বিএনপি। ২০২২ সালের অক্টোবরে জামায়াতের আমিরই একটি রুকন সম্মেলনে বলেছিলেন, তারা আর বিএনপির সঙ্গে জোটে নেই।

মির্জা ফখরুল বিষয়টি স্বীকার না করলেও ওই বছরের ৯ ডিসেম্বর এক বিদেশি সংবাদকর্মীর প্রশ্নে স্বীকার করেন, তারা ২০ দলীয় জোট ভেঙে দিয়েছেন।

Related posts

তাঁতিবাজারে পূজামণ্ডপের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ ভারতের

Ny Bangla

শেখ হাসিনার পতন: নেপথ্যে চারজন

Ny Bangla

এখনও নেভেনি গাজী টায়ার কারখানার আগুন

Ny Bangla

সেনাপ্রধান ওয়াকারকে যে তিন প্রশ্নের জবাব দিতেই হবে

Ny Bangla

অবশেষে জামিন পেলেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান

Ny Bangla

ইউনূস সরকারকে সহায়তার আশ্বাস জাতিসংঘের

Ny Bangla

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Privacy & Cookies Policy