New York Bangla Life
বিশেষ প্রতিবেদন

বাংলাদেশের পরিস্থিতি কি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে?

এনওয়াই বাংলা স্পেশাল: কোটা আন্দোলনকারীরা খোলাখুলি সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর কথা বলেছেন। পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল পরিশোধ না করে অসহযোগের ডাকও দিয়েছেন।

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলনকারীরা এবার সরকার পতনের ডাক দিল। একই দিন তাদের সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্যে এক পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। কোটা আন্দোলনকারীদের কর্মসূচিতে মিছিল নিয়ে যোগ দিল ছাত্রদল। আর মন্ত্রিপরিষদের একজন সদস্য ক্ষমা চাইলেন ছাত্রদের কাছে।

এই ঘটনাগুলো যখন এক দিনে ঘটেছে, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, পরিস্থিতি কি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে? শেষ পর্যন্ত তা সরকার পতন আন্দোলনে ধাবিত হচ্ছে?

রাজপথে আওয়ামী লীগের তৎপরতা নেই বললেই চলে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পত্রিকায় বিবৃতি পাঠচ্ছেন, কখনো সংবাদ সম্মেলনে বা দলীয় ঘরোয়া কোনো আলোচনায় বক্তব্য রাখছেন।

এর মধ্যে বিএনপির আমলে পুলিশে যোগ দেওয়া বিসিএস অফিসারদের পক্ষ থেকে একটি লিফলেট ছাড়া হয়েছে, ফেইসবুকে সংঘাতে প্রাণহানির পুরনো ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে নতুন ঘটনা বলে, আবার সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে কিছু মানুষ ‘এই মুহূর্তে দরকার, সেনাবাহিনীর সরকার’ বলে স্লোগান দিচ্ছে।

কদিন ধরেই স্পষ্ট হচ্ছে যে কোটা আন্দোলন আর সরকারি চাকরিতে কোটার দাবির মধ্যে সীমিত নেই, এখানে নানা পক্ষ ও গোষ্ঠী জড়িয়ে পড়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন অতিরিক্ত উপকমিশনার জানিয়েছেন, তাদের কাছে প্রতিবেদন ছিল দেশে নভেম্বরের মধ্যে একটি ঝামেলা হতে পারে। সরকারকে সেটা জানানো হয়েছিল। সেটি আগেই ঘটে গেছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই মুহূর্তে যেসব দাবি সামনে আনছে, তার মধ্যে আছে গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার, হত্যার তদন্ত করে বিচার ইত্যাদি ইত্যাদি।

সরকারের তরফে তদন্তের দাবিকে ফেলে দেওয়া হয়নি। তিন সদস্যের বিচারিক কমিশন গঠন করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী পরপর দুই দিন তদন্তে জাতিসংঘের সহযোগিতা চেয়েছেন, বলেছেন প্রতিটি হত্যার তদন্ত করে বিচার হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি থামছে না।

এর মধ্যে নাগরিক সমাজ নামে বামপন্থি ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠন, তাদের পেশাজীবী সমাজ, নাগরিক সমাজ, শিক্ষকদের সংগঠনগুলোও মাঠে নেমেছে, দ্রোহ যাত্রা নামে বড় একটি মিছিল হয়েছে জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত।

সেই কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে বামপন্থি অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেছেন, আনু মুহাম্মদ বলেন, “যারা হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল তাদের বিচার করতে হবে। এ হত্যাকাণ্ডের দায় শিকার করে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। আমাদের প্রধান আলোচ্য বিষয়, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে।”

একই দাবিতে একই দিন বিবৃতি দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সারা দেশ সরকারের বিরুদ্ধে একাট্টা দাবি করে তিনিও ‘গণহত্যার’ দায় নিয়ে সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছেন।

একই দিন মিরপুর ডিওএইচএসে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও পরিবারের সদস্যদের একটি মিছিল বের হয়। সেখানে অন্য মানুষও যোগ দেন। পরে তারা একটি সমাবেশ করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে।

তবে এই অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে নয়। কয়েক মাস আসে কর্নেল (অব.) আব্দুল হকের নেতৃত্বে বিএনপিতে যোগে দেন বেশ কয়েকজন। তাদের নেতৃত্বেই হয় এই মিছিল। 

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাহিন সরকার সাংবাদিকদের এক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই কর্মসূচির মধ্যে শনিবার বিক্ষোভের পাশাপাশি রোববার থেকে সর্বাত্মক অসহযোগের কথা বলা হয়েছে।

এই অসহযোগের ব্যাখ্যা কী- এই প্রশ্নে ফেসবুক লাইভে এসে কথা বলেছেন আরেক সমন্বয়ক আবদুল হান্নান। 

তিনি বলেন, “এই সরকারকে কোনো কর দেওয়া হবে না, বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল দেওয়া হবে না, সচিবালয় ও সরকারি-বেসরকারি সব কার্যালয় বন্ধ থাকবে, গণভবন-বঙ্গভবনে কোনো গাড়ি ঢুকবে না। এই সরকারকে সর্বাত্মক অসহযোগিতা করা হবে।”

সরকার যাতে আর না থাকতে পারে, সে জন্য সবাইকে এসব কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানান তিনি।

গত কয়েক দিন ধরে তাদের আন্দোলনের যে প্রকৃত উদ্দেশ্য সরকার পতন, সেই বিষয়টিই এই বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এদিন দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের গণমিছিলের কর্মসূচি ছিল। সেই মিছিলকে ঘিরে ঢাকার উত্তরায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে। তবে ফেসবুকে ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে যেখানে দেখা যায় মরদেহ সড়কে পড়ে আছে। তবে সেগুলো পুরনো ভিডিও বলেই পরে চিহ্নিত হয়।

এর মধ্যে হবিগঞ্জে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে এক যুবক নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

নিহত মোস্তাক আহমেদের বয়স ২৬ বছর। তিনি পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (পিজিবি) ঠিকাদারের অধীনে লাইনম্যানের কাজ করতেন এবং তার বাড়ি সিলেটের টুকেরবাজার এলাকায় বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

এর আগে হবিগঞ্জ শহরের তিনকোনা পুকুরপাড় এলাকায় বেলা সাড়ে ৩টার দিকে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবু জাহিরের বাসার গেট ভাঙচুর ও ১০টি মোটরসাইকেল অগ্নিসংযোগ করা হয়। জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়েও দেওয়া হয় আগুন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মষূচিতে অংশ নিতে জুমার নামাজের পর হবিগঞ্জ শহরের কোর্ট মসজিদের সামনে অবস্থান নেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় পূর্ব টাউন হল এলাকায় অবস্থান নেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ওই সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের মিছিলে যোগ দিয়ে সংহতি প্রকাশ করেন বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।

এক পর্যায়ে মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় টাউন হল এলাকায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ বাঁধে। সেখানে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবু জাহিরের বাসায়ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং তার বাসার সামনে থাকা দশটি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়া হয়।

এর মাঝে পড়েই মারা যান মোস্তাক।

সন্ধ্যায় নগরীর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন গল্লামারী এলাকায় সংঘর্ষ চলাকালে মারা যান পুলিশের কনস্টেবল সুমন ঘরামি।

বিকালে সংঘর্ষ চলাকালে আন্দোলনকারীরা এই কনস্টেবলকে বেধড়ক মারপিট করে। পরে খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এসব ঘটনায় সরকার যে বিচলিত সেটি প্রকাশ পেয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের কথায়। এই প্রথমবার সরকারের কারও কাছ থেকে অতি নমনীয় বক্তব্য এল।

নাটোরে নিজ বাসভবনে শোক দিবসের আলোচনায় তিনি স্বীকার করেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের ‘ভুল বোঝাবুঝি’ হয়েছে। এর দায় নিয়ে তিনি বলেন, “আমি মনে করি এই দূরত্ব হওয়ার জন্য ছাত্রছাত্রীদের দোষ নেই, এটি আমাদের দোষ, এই দায় আমাদের, যারা আমরা দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছি, এই ব্যর্থতা আমাদের এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।”

তিনি আরও বলেছেন, “বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে, জননেত্রী শেখ হাসিনার কর্মী হিসেবে, আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আমার তরুণ প্রজন্মের কাছে যদি আমার কোনো ভুল ত্রুটি হয়ে থাকে, আমি করজোড়ে, প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”

শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের বদলে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলেছেন তিনি। 

পলক বলেন, “আমরা যেন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের প্রতি কঠোর শাসনের পথ বেছে না নিয়ে… আমরা যদি তাদের প্রতি সংবেদনশীল হই এবং তাদের প্রতি একটু স্নেহ মমতা নিয়ে কাদের কাছে বসি, তাদের কথা শুনি, তাহলে আমার বিশ্বাস অবশ্যই এই ভুল বোঝাবুঝি দূর হবে, এই দূরত্ব দূর হবে এবং যারা ষড়যন্ত্রকারীরা আমাদের সরকারের সাথে ছাত্র ছাত্রী ও সাধারণ জনগণের দূরত্ব তৈরি করার একটা ষড়যন্ত্র করছে, তারা সেই ষড়যন্ত্রে কখনও সফল হবে না।”

বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে- এমন কথাও তুলে ধরেছেন প্রতিমন্ত্রী। উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছেন ইরাক, সিরিয়া, মিশরের কথা। বলেছেন, “কীভাবে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সেই দেশের সরকার, সেই দেশকে কীভাবে ধ্বংস করে গোটা প্রজন্মকে গত ২০/৩০ বছরে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।”

Related posts

দেশবাসী হুঁশিয়ার, মন্ত্রীসভায় রাজাকার

Ny Bangla

শেখ হাসিনাকে ফাঁসিয়ে আওয়ামী লীগকে ১০ বছর নিষিদ্ধের ছক

Ny Bangla

শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলে আন্দোলনকারীদের কী লাভ, সংবিধান কী বলে

Ny Bangla

বেশুমার হামলা আর ‘ডাকাতের কবলে’ বাংলাদেশ, কে দেবে আশা?

Ny Bangla

ইউনূসের ‘আসল উদ্দেশ্য’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে কী বোঝাতে চাইলেন ফখরুল?

Ny Bangla

‘গায়েবি’ ও ‘ঢালাও’ মামলাগুলো টিকবে তো?

Ny Bangla

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Privacy & Cookies Policy