নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীর প্রকাশ্যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই খিলাফত প্রতিষ্ঠার স্লোগানে চলছে নানা কর্মসূচি। আইজিপি তাদেরকে জঙ্গি সংগঠন বলার পর তাকে হুমকির সুরে দেওয়া হয়েছে বিবৃতি।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সময় নিষিদ্ধ থাকা জামায়াতে ইসলামী আর হিযবুত তাহরীরের এখন রমরমা।
সরকার পতন আন্দোলনে দুই সংগঠনই অংশ নিয়েছে সক্রিয়ভাবে, নীতি নির্ধারণসহ সংঘাতে নিজেদের অবদানের কথা জানান দিচ্ছে প্রকাশ্যেই। জামায়াতের নিষেধাজ্ঞা মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার তুলে দিতে সময় নেয়নি এক মাসও। অন্যদিকে হিযবুত তাহরীরও এই আবেদন করে রেখেছে।
৫ আগস্ট থেকেই জামায়াত ও হিযবুত প্রকাশ্যে মিছিল সমাবেশ করতে থাকে। হিযবুতের ইসলামী খেলাফত আর কালেমার পতাকা উড়তে থাকে সরকার পতন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতেই।
২০০৯ সালে বাংলাদেশে আর এর আগে তুরস্ক, পাকিস্তান, মিসরসহ বিভিন্ন আরব দেশে উগ্রবাদের জন্য নিষিদ্ধ সংগঠনটির এভাবে প্রকাশ্যে চলে আসা নিয়ে এখন প্রমাদ গুনছে মানুষ।
এর মধ্যে বিবিসি বাংলাকে ভিডিও সাক্ষাৎকার দেন হিযবুতের মিডিয়া সমন্বয়ক ইমতিয়াজ সেলিম। জানান, সরকার পতন আন্দোলনে ১৮ জুলাই থেকেই তাদের কর্মীরা ছিলেন সক্রিয়, তারা জীবন দিয়েছেন। ৫ সেপ্টেম্বর তারা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আবেদনও করেছেন।
এরপর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে, চট্টগ্রামে, সিলেটে নিজস্ব ব্যানারেই চলতে থাকে তাদের কর্মসূচি, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ভিন্ন এক নামে সেমিনার করেছে অর্থনীতির বিষয়ে।
এ নিয়ে সমালোচনার মুখে অবশেষে ২৮ সেপ্টেম্বর মুখ খোলেন আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম। চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “হিযবুত তাহরীর ‘জঙ্গি’ সংগঠন। সে ব্যাপারে আমাদের মামলা হয়েছে। আমাদের গ্রেপ্তার অভিযান চলছে, চলবে। ‘জঙ্গির’ ক্ষেত্রে আমরা আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
কিন্তু এর পরদিন থেকে হিযবুত কর্মীরা দেখায় ভেলকি। ঢাকা কলেজ, নটরডেম কলেজসহ একাধিক স্কুল থেকে কালেমা লেখা কালো পতাকা নিয়ে বড় বড় মিছিল করতে থাকে তারা।
ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য পাদদেশেও হয় কর্মসূচি, বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ফেসবুক পেজে তাদের পতাকা ছড়ানো হচ্ছে। মহানবী (স.) কে সমালোচনা করলে হত্যা করার প্রকাশ্য হুমকি দেওয়া হয়েছে।
শুরুর দিকে নিজের নামে করলেও এখন অবশ্য কর্মসূচিতে হিযবুত নিজের নাম ব্যবহার করছে না। তবে তাদের পতাকা, সংগঠনের ব্যবহার করা কমলা ও কালো রঙের উপস্থিতিতে নিজেদের জানান দিতেও ভুল করেনি সংগঠনটি।
এখানেই থেমে থাকেনি তারা। হিযবুত তাহরীরের মিডিয়া অফিস বাংলাদেশ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি ছাড়া হয় ফেসবুকে, সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশে খিলাফত প্রতিষ্ঠা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আইজিপিকে উদ্দেশ করে হুমকির সুরে এই বিবৃতিতে লেখা হয়, “একজন মুসলিম হিসেবেও আপনার দায়িত্ব হচ্ছে এই ভূখণ্ডে ইসলামের জীবনধারাকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করা। আপনার উচিত ইসলামের দাওয়াহকে রক্ষা করা এবং দাওয়াহ বহনকারীদের সুরক্ষা দেওয়া। দেশের মানুষ আপনাকে কখনই সহ্য করবে না যদি আপনি হাসিনার সেই আগের পুলিশ প্রধানদের মতই ‘ভারতের মুখপাত্রে পরিণত হন’।”
হিযবুত তাহরীরের এসব বক্তব্য আর কর্মীদের মিছিলের ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। এর মধ্যে অবশ্য মিডিয়া সমন্বয়ককে গ্রেপ্তার করে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
এর প্রতিক্রিয়ায় হিযবুতের আরেক বিবৃতিতে বলা হয়, “অন্তর্বর্তী সরকার কি পশ্চিমা শক্তিদের প্রতি ও ভারতের প্রতি অনুগত?”
বাংলাদেশে ১৯৯০ দশক থেকেই জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ সক্রিয় ছিল। পরে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠতে থাকে নতুন নতুন সংগঠন। ইসলামিক স্টেটস বা আইএসের হয়ে লড়াই করতে বাংলাদেশ থেকে ইরাক সিরিয়ায় চলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বহু।
সরকার পতনের পর হিযবুত থেকে শুরু করে উগ্রবাদীদের এখন পোয়াবার। এজ মধ্যে জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আটক নেতা জসীমউদ্দিন রাহমানি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন, জেল ভেঙে পালিয়ে গেছেন বহু সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি।
কিন্তু বাংলাদেশের সরকার এতদিন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। কিন্তু বৈশ্বিকভাবেই এখন বাংলাদেশে উগ্রবাদের বিকাশের সম্ভাবনা নিয়ে কথা হচ্ছে।
গ্লোবাল অর্ডার নামে ইংরেজি ভাষার একটি ম্যাগাজিনে লেখা হয়েছে বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে উগ্রবাদের বিকাশের আশঙ্কার বিষয়ে।
এতে লেখা হয় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান ইসলামী চরমপন্থা এবং অ্যামেরিকার হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এসেছে।
অ্যামেরিকার ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) সাম্প্রতিক ফাঁস হওয়া নথির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে প্রভাবিত করতে বিদেশি স্বার্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
মুহাম্মদ ইউনূসের ওয়াশিংটন, ডিসির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া আইআরআই-এর নথিগুলো অ্যামেরিকার গোপন পরিকল্পনার প্রমাণ দেয়। এর দাবি অনুযায়ী, শেখ হাসিনা সরকারের পতন ত্বরান্বিত দেশটি গোপনে কাজ করছে।
দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সীমানায় অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশ একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েরই বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকায় এটি অ্যামেরিকার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়েছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যত দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় শক্তির খেলায় জড়িত।
বাড়তে থাকা ইসলামী চরমপন্থা
জন্মের পর থেকেই বাংলাদের লড়াই ছিল ইসলামী চরমপন্থার বিরুদ্ধে। দেশটি তার ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য পরিচিত হয়ে উঠে। তবে গত দুই দশকে, ইসলামি চরমপন্থার উত্থান দেশটির স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই চরমপন্থার বহিঃপ্রকাশ ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার, বুদ্ধিজীবী, এলজিবিটি কর্মী এবং হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানদের মত সংখ্যালঘু ধর্মের লোকদের উপর হামলায় দেখা গেছে।
২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাবিদ এবং প্রগতিশীল কর্মীদের উপর হামলা বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করে।
সে সময় তরুণরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনে নামে। ইসলামী গোষ্ঠীগুলোর প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র এবং সহিংস। প্রকাশ্য দিবালোকে পরিচিত ব্লগার এবং কর্মীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
আনসার আল-ইসলাম, আল-কায়েদা-সংযুক্ত একটি দল এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর মতো দলগুলো কিছু হামলার দায়ও স্বীকার করেছে।
এই সংগঠনগুলো সমাজের মধ্যে বিদ্যমান অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিকে দুর্বল করে দিতে চাইছে।
২০১৫ সালে, আল-কায়েদার সাথে যুক্ত চরমপন্থীদের অর্থায়নের অভিযোগে পাকিস্তানি কূটনীতিকদের দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পশ্চিমা বিশ্ব এর জন্য পাকিস্তানকে জবাবদিহি করেনি।
২০১৬ সালে ঢাকা হোলি আর্টিজান বেকারিতে পাঁচ বন্দুকধারীর নৃশংস হামলা ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি বিপজ্জনক বার্তা। এই আক্রমণে ২২ জন মানুষ নিহত হয়, যাদের মধ্যে একটি বড় অংশ ছিল বিদেশি। এই হামলা আন্তর্জাতিক জিহাদিদের বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহের প্রমাণ হিসেবে দেখা দেয়।
ক্রমবর্ধমান ইসলামী চরমপন্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংস আক্রমণ বেড়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, মন্দির, ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছে।
চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকায় বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টানরাও হয়রানি এবং সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।
২০২১ সালের কুমিল্লায় দুর্গা পূজার সময় গুজব ছড়িয়ে মন্দিরে হামলা করা হয়। এরপর দেশের বিভিন্ন এলাকাতেই হিন্দুরা আক্রান্ত হয়।
সরকার পতনের পর ঢাকায় তালেবানের পতাকা বিক্রি এবং উড়ানো হয়েছে। ইসলামী শক্তি বাড়ছে।
ক্রমবর্ধমান ইসলামী চরমপন্থা দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, লিখেছে গ্লোবাল অর্ডার।
এর মধ্যে ইউনূস আবার হেফাজতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে মাখামাঝি বাড়িয়েছেন, তার উপদেষ্টা পরিষদে নেওয়া হয়েছে হেফাজতের সাবেক এক উপদেষ্টাকে। হেফাজতের উগ্রবাদী অন্য নেতারা সংলাপে এসে ইউনূসকে ঘিরে ধরে ছবি তুলেছেন।