আলি শরিয়তি, লেখক
(দ্বিতীয় পর্ব)
২৩ জুন একটি ঐতিহাসিক দিবস। ৯৩০ সালের ২৩জুন পৃথিবীর প্রাচীনতম সংসদ আইনল্যান্ড সংসদ যাত্রা শুরু করে। ইতিহাসের পাতায় এখান থেকেই ২৩জুন তারিখের গুরুত্ব পাওয়া যায়। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে ১৭৫৭ সালের ২৩জুন, ১৯৪৯ সালের ২৩জুন, ১৯৯৬ সালের ২৩জুনের পরে ২০২৪ সালের ২৩জুনের গুরুত্বও অপরিসীম।
২০২৪ সালের ২৩জুন আওয়ামী লীগের প্লাটিনাম জুবিলি ছিল। এই তারিখেই জেনারেল ওয়াকারুজ্জামান সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বলাবাহুল্য, ৫ আগস্ট ছাত্র-গণ ও সামরিক অভ্যুত্থানের নায়কের উত্থানের বীজ রোপিত হয়েছিল মাত্র কয়েকদিন আগের ২৩জুন। যেদিন আওয়ামী লীগের ৭৫বছর পূর্তি হলো, সেদিনই আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দামামা বেজে উঠেছিল, গণভবন প্রাঙ্গণে। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এই সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে।
স্বশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার(পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান, সেনা সদর দপ্তরের অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল(এজি) মে জে মোঃ মাসুদুর রহমান, সেনা সদর দপ্তরের সামরিক সচিব(এমএস) মীর মুশফিকুর রহমান, এই ত্রয়ীর সম্পর্কে প্রথম পর্বে কিঞ্চিৎ লিখেছিলাম।
হিসেব করলে দেখা যাবে, ২০০৯ সালে তারা যথাক্রমে কর্নেল ও মেজর পদে ছিলেন। এরপরের সবগুলো প্রমোশন শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের বদৌলতেই পেয়েছেন। অন্তত তাঁদের ভাষ্যমতে, শেখ হাসিনার সরকার দলীয়করণ যদি করে থাকে, তাহলে সেটার সুবিধাভোগীও তারা। কিন্তু এখন ফেরেশতা সেজেছে। তারা ও তাঁদের বলয়ভুক্ত অফিসারেরাই শুধু যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রমোশন পেয়েছে, বাকীরা সবাই আওয়ামী দালাল।
এরকম একটি ন্যারেটিভ স্টাবলিশ করতে কয়েকটি ফর্মুলা এপ্লাই করছে। সেনাপ্রধানের কিচেন ক্যাবিনেটের সদস্য হওয়ায় চীফের মনস্তত্ব তাঁদের নখদর্পণে। ভেতরের সকল খবর বিদেশে অবস্থিত তথাকথিত সাংবাদিক, ব্লগার, একটিভিস্টের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। এরা মনের মাধুরি মিশিয়ে সবাইকে শেখ হাসিনার দালাল বানাচ্ছে। এসব লেখাগুলো আবার সেনাপ্রধানের সামনে তুলে ধরছে এই ত্রয়ী ও তাঁদের সাগরেদ অফিসারেরা।
ছাত্র সমন্বয়কদের সাথে নিবির সম্পর্ক রাখছে। তাদেরকে নানান সত্য-মিথ্যা তথ্য অপতথ্য সরবরাহ করছে। যে সবের ভিত্তিতে সমন্বয়কেরা প্রধান উপদেষ্টার মাধ্যমে সেনাপ্রধানকে টাইট দেওয়াচ্ছে।
এসবের আসল উদ্দেশ্য হলো বর্তমান সেনাপ্রধানের দুর্বলতাগুলোর সুযোগ নিয়ে তাঁকে সরিয়ে এস এম কামরুল হাসানকে সেনাপ্রধান করা। এজন্য সিজিএস লেফটেন্যান্ট জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম ও এনডিসি কমান্ড্যান্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ শাহিনুল হককে অবসরে পাঠাতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই কামরুল হাসানের সেনাপ্রধান হবার সুযোগ হাতের নাগালে চলে আসবে। এতোদিন সেই চেষ্টাই চলেছিল। কিন্তু সমস্যা হয়েছে গোপন খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ায়।
ছাত্র সময়ন্বয়কদের জানানো হয় সেনাপ্রধান ভারতের পারপাস সার্ভ করছে এবং ডিজিএফআই এর ডিজি মেজর জেনারেল মোঃ ফয়জুর রহমান এক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা রাখছে। বাস্তবতা হলো সেনাপ্রধান মার্কিনপন্থী অফিসার এবং ফয়জুর রহমান যতটা মার্কিনপন্থী, এরচেয়ে বেশি ভারত ও ইসরায়েল বিরোধী। তবুও তাদেরকে ভারতবান্ধব হিসেবে ছাত্রনেতাদের কাছে বার্তা দেয়া হয়।
পাঁচ সমন্বয়ক মাহফুজ, নাহিদ, আসিফ, সারজিস ও হাসনাত গোপন মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেন সেনাপ্রধানকে সরাতে হবে। নইলে বিপ্লবের চেতনা ভুলুণ্ঠিত হবে। যেকোনভাবেই এই তথ্যটি ফাঁস হয়ে যায়। ওয়াকারুজ্জামান সাহেব নড়েচড়ে বসেন। রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বারবার ইউনূস সরকারের প্রতি আনুগত্যের কথা উল্লেখ করেন। সেনাপ্রধানের জন্য আরেকটি বিব্রতকর বিষয় হলো, আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহেই যমুনায় ইউনূসের উপস্থিতিতে একদিন ছাত্রনেতারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, আপনি কথা কম বলবেন এবং সরকারের অর্ডার ফলো করবেন। রাজনীতি নিয়ে কোনো কথা বলার ওপরে অনেকটা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এজন্য ফাঁস হওয়া তথ্যটি সঠিক বলে গ্রহণ করেন সেনাপ্রধান।
এভাবেই জটিলতা বাড়ছে, বেড়েই চলছে। সেনাবাহিনীতে আর্টডক ও কিউএমজি, এই দুটি লেফটেন্যান্ট জেনারেল এর পদ ফাঁকা প্রায় দুই মাস ধরে। এটা এক নজিরবিহীন ঘটনা। অথচ কাউকে প্রমোশন দিয়ে এসব পদে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে না। কারণ সেই ত্রয়ীর ষড়যন্ত্র। নিয়মানুযায়ী যাদের পদোন্নতি হবার কথা, তাদেরকে আগেই মিডিয়া ট্রায়ালে ফেলে বিতর্কিত করে ফেলা হচ্ছে। এজন্যই মেজর জেনারেল হামিদকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এরপরে যারা সিরিয়ালে আছে সবাইকে ফেইসবুক, ট্যুইটার ও ইউটিউবে লেখালেখি করিয়ে বিতর্কিত করা হচ্ছে।
এভাবেই একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে একশ্রেণির অসাধু ও মতলববাজ কর্মকর্তারা, যারা এই বাহিনীতে চাকুরির সুবাধেই সম্মান অর্জন করেছেন এবং অর্থ উপার্জন করে সাবলম্বি হয়েছেন। অথচ তারাই প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। এসবের উত্তর খুঁজে পেতে হিজবুত তাহরিরের ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বুঝতে হবে।
হিজবুত তাহরিরের লেখা ৪৫পৃষ্ঠার সংবিধান সম্পর্কে জানতে হবে। হিজবুত তাহরির কখনও-ই নির্বাচন নয়, তারা সামরিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই বাংলাদেশে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখে এবং সেই লক্ষেই তাঁদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে গত প্রায় দুই দশক ধরে।
আচ্ছা, ৫আগস্টের পরে সেনাছাউনিগুলোতে অনেক বেসামরিক ব্যক্তিকে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল। যা সেনাপ্রধান ও আইএসপিআর জানিয়েছিল। তারা বেরিয়ে গেলো কিভাবে? এর পেছনে কারা কলকাঠি নেড়েছিল? পাঠককে জানানোর ইচ্ছা রইল।
#আলিশরিয়তি