New York Bangla Life
বাংলাদেশ

শ্রদ্ধা নিবেদনে বাধা, মারধর: অবরুদ্ধ ধানমন্ডি ৩২

১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। গত মঙ্গলবার এই দিনের সরকারি ছুটি বাতিল করা হয়। রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের জাদুঘরে আগেরদিন রাত থেকে লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা।

ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বাধার মুখে ফিরে গেছেন অনেকে। মারধরের শিকার হয়েছেন কেউ কেউ।


তবে সকাল থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কোনো নেতাকে দেখা যায়নি।

এর আগে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।

সরেজমিন দেখা যায়, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়ক এবং আশপাশের এলাকা ছাত্র-জনতার দখলে। অনেক মানুষ লাঠি, বাঁশ, পাইপ নিয়ে অবস্থান করেন। অনেকের মাথায় জাতীয় পতাকা বাঁধা।


এই এলাকায় কেউ এলে কিংবা এখান দিয়ে যাতায়াতরত পথচারীদের থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কোথায় যাচ্ছেন, কেন এসেছেন, তা জানতে চাওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উপস্থিতিও দেখা যায়।


কাউকে সন্দেহ হলেই তল্লাশি করা হয় মোবাইল ফোন, সামাজিক মাধ্যমের অ্যাপের ব্যক্তিগত তথ্য। আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা পেলেই নানাভাবে হেনস্থা করা হয়। কয়েকজন পথচারী অনেকের পরিচয়পত্র, মুঠোফোন দেখা হয়। বলা হয়, এখানে ভিডিও করা যাবে না; ছবি তোলাও নিষেধ। ছবি তোলার কারণে অনেককে অপদস্থ করা হয়।


সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময় আন্দোলনকারীদের মোবাইল ফোন তল্লাশি করেছে বলে অভিযোগ আছে। কারো কারো বাসায় ঢুকে মোবাইল ফোন দেখে ‘অযাচিত’ কিছু পাওয়া গেলে তা ডিলিট করে দেওয়া কিংবা আন্দোলনকারীকে তুলে নিয়ে যাওয়া, পরবর্তিতে মামলা দেয়ার অভিযোগও রয়েছে।

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দেখা যায়, আন্দোলনকারীদের অনেকে মিছিল করে রাপা প্লাজা ঘুরে আবার ৩২ নম্বরে আসে। মাঝে মাঝে মিছিল নিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। উত্তপ্ত স্লোগান দেয়া হচ্ছে মিছিল থেকে। এছাড়া, পান্থপথ মোড় থেকে রাসেল স্কয়ার পর্যন্ত ছোট ছোট দল করে অবস্থান নিয়েছিল আন্দোলনকারীরা। শুক্রাবাদ, মেট্রো শপিং মল, ধানমন্ডি লেক সংলগ্ন এলাকাও আন্দোলনকারীদের দখলে। এসব এলাকায় সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ছিল সতর্ক অবস্থানে।

অপরদিকে শ্রদ্ধা জানাতে আসা কয়েকজনকে মেরে, লাঠিপেটা করে নিউ মডেল কলেজে আটকে রাখা হয়। দুপুর পৌনে ১টার দিকে সেনাবাহিনীর চারটি এবং বিজিবির একটি গাড়ি নিউ মডেল কলজের সামনে এসে থামে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গাড়ি থেকে নেমেই হুইসেল বাজিয়ে কলেজের সামনে থাকা আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেন।


পরে কয়েকজন সেনাসদস্য কলেজের ভেতরে ঢুকে আটকে থাকা ব্যক্তিদের বের করে গাড়িতে তোলেন। এর মধ্যে একটি গাড়িতে ৯ জন নারী এবং দুটো গাড়িতে ২০ জনের বেশি পুরুষকে তোলা হয়। এরপর গাড়িগুলোকে পান্থপথের দিকে চলে যেতে দেখা যায়।

কালো রংয়ের পোশক পরিহিত কাউকে পেলেই বা কালো ব্যাজ ধারণ করলেই নানাভাবে নাজেহাল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক পরিচয় পেলেই মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। আহতদের অনেককে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে বলেও জানানো হয়। শ্রদ্ধা জানাতে আসা কয়েকজনকে হাত বেধে দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় বসিয়ে রাখার ঘটনাও ঘটে। জানা যায়, শ্রদ্ধা জানাতে আসা অন্তত ১৬ জনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে আন্দোলনকারীরা।

দলীয় বা সাধারণ কাউকে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে যেতে দেয়া হয়নি। ঐতিহাসিক এই বাড়ির সামনের রাস্তাটির দুই প্রান্তই কাঁটাতার দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।

নানা অযুহাতে কেউ ঢুকতে চাইলে তাকে অপদস্থ করা হয়। কাউকে কাউকে ধাওয়া দিতে দেখা যায়। জটলা পাকিয়ে কাউকে মারধর করতেও দেখা যায়।


গণমাধ্যমকর্মীদেরও হেনস্থা করার অভিযোগ উঠেছে। গলায় গণমাধ্যমের ফিতা ঝোলানো দেখলেই পথ আটকে নানা প্রশ্ন করা হয়। পরিচয়পত্র দেখে পত্রিকার ওয়েবসাইটে ঢুকে যাচাই করা হয় গণমাধ্যমটি আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে কোন খবর ছেপেছে কিনা।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী। সকাল সাতটার দিকে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে তার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।


সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘আমি সকাল সাতটার দিকে ফুল দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু দিতে পারিনি। খুবই ভালো লেগেছে যে দু-একজন সালাম দিয়ে বলেছে, আপনি ফিরে যান। আমি গাড়ির ভেতরে ছিলাম। কয়েকজন ঢিল ছুড়েছে। লাঠি দিয়ে গাড়ি ভেঙেছে। তারপর আমি চলে এসেছি।’


মুক্তিযুদ্ধে বীর উত্তম খেতাব পাওয়া এই রাজনীতিবিদের মতে, কেউ মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশকে স্বীকার করলে তাকে স্বীকার করতে দেয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘গত ১৫-১৬ বছর আওয়ামী লীগ গায়ের জোরে চলেছে। এখনো চর দখলের মতো হচ্ছে। এসব করলে ছাত্ররা জীবন দিয়ে যে সফলতা এনেছে, সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

১৫ আগস্ট ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিক ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের এই বাড়িতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে।

আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরের শাসনকালে প্রতিবছর ১৫ আগস্ট বহু মানুষ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আসতেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।

তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। প্রবল গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ওই দিন ৩২ নম্বরের এই বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। পুড়ে ছাই হয়ে যায় সবকিছু।


ভারত থেকে এক বার্তায় শেখ হাসিনা দেশবাসীকে ১৫ আগস্ট পালনের আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদেরও ঢাকা আসার নির্দেশ দেন মোবাইল ফোনে স্থানীয় এক নেতার সঙ্গে আলাপকালে। দলীয় প্রধানের নির্দেশনা অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের এ দিন ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু ভবনে পুষ্প মাল্য অর্পণ করে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর কথা।

তবে, সদ্য ক্ষমতাচ্যূত দলটি যেন কোনো কর্মসূচি পালন করতে না পারে, সেজন্য আগে থেকেই রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়ে ‘রেজিস্ট্যান্স উইক’ নামে নতুন কর্মসূচি দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।


ছাত্র আন্দোলনের দাবি, আওয়ামী লীগ ও দলটির সহযোগীরা ১৫ আগস্টে ‘পাল্টা অভ্যুত্থানের’ চেষ্টা করতে পারে। এই প্রেক্ষিতে আন্দোলনের সমন্বয়কেরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ দিন রাজপথে থাকার আহ্বান জানান। তারা বলেন, পাল্টা অভ্যুত্থান বা এ ধরনের কোন চেষ্টা প্রতিহত করতেই সবাই মাঠে থাকবে।

এদিন বনানী কবরস্থানে ছিল ভিন্ন চিত্র। বেলা পৌনে এগারোটার দিকে দেখা যায়, অল্প কয়েকজন মানুষ এখানে দাঁড়িয়ে মোনাজাত করে চলে যান। সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের সঙ্গে তারা কেউ কোনো কথা বলেননি। আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদেরর কাউকে কাউকে বিচ্ছিন্নভাবে এসে কবর জিয়ারত করতে দেখা যায়। আবার কেউ এসে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে গেছেন চুপচাপ।


বঙ্গবন্ধুবঙ্গবন্ধুকে টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করা হলেও তার এই কবরস্থানে তার স্ত্রী ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরসহ পরিবারের ১৮ সদস্যকে দাফন করা হয়।

অপরদিকে আগের রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হওয়া সব হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির সামনে অবস্থান কর্মসূচি ও মোমবাতি মিছিল করা হয়।


জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচীর নেতৃত্বে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের পরেই রোকেয়া প্রাচীর ওপর হামলা চালায় বিরোধীরা। এসময় শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হন তিনি।



হামলার বিষয়ে রোকেয়া প্রাচী বলেন, “সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে আমাদের ওপরে অতর্কিত হামলা হয়। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করছিলাম। হঠাৎ আমাদের ঘিরে ধরে বেধড়ক পেটানো হয়।”
গুরুতর আহত হওয়ার অভিযোগ করে তিনি বলেন, “যারা পিটিয়েছে তারা আমাকে টার্গেট করে এসেছে। প্রত্যেককে আমার শিক্ষিত মনে হয়েছে। তারা খুব শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেছে। তাদের কথাবার্তা শুনেই বুঝেছি তারা দুষ্কৃতকারী নন।”

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে রোকেয়া প্রাচী বলেন, “আজ আমরা সবাই এখানে একত্রিত হয়েছি, কারণ বাংলাদেশ পুড়েছে। আমরা সবাই একত্রিত হয়েছি, কারণ আমাদের ১৯৭১ পুড়েছে। আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি, কারণ আমাদের বঙ্গবন্ধুর ছবি পুড়েছে। ধানমন্ডির ৩২ পুড়েছে। আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি বাংলাদেশ পুড়েছে বলে। আমরা এখানে কোনো রাজনীতির কথা বলতে আসিনি। বাংলাদেশ আমাদের সবার।”

তিনি বলেন, “আমরা এখানে শোক প্রকাশ করতে এসেছি শান্তিপূর্ণভাবে। আমরা বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করি। তিনি আমাদের জন্য এই বাংলাদেশ দিয়েছেন, সংবিধান দিয়েছেন। এই ৩২ যখন পুড়েছে, তখন আমাদের মনে হয়েছে আমরা পুড়েছি। আমরা ধানমন্ডি ৩২-এ দাঁড়িয়ে সারা বিশ্বের এই মহানায়কের কাছে ক্ষমা চাইছি, আমরা লজ্জিত, বাঙালি জাতি আজ লজ্জিত।”

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আইন ও বিচারবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন রোকেয়া প্রাচী। তাঁর বাবা আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আমলে মিরপুর ও পল্লবী শ্রমিক লীগের সভাপতি।

উল্লেখ্য, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পালিত এই জাতীয় ছুটি বাতিল করেছে।

Related posts

সাইডলাইনে বৈঠক হতে পারে নরেন্দ্র মোদি ও ড. ইউনূসের

Ny Bangla

উপাচার্য ও শিক্ষকদের সঙ্গে গণভবনে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী

Ny Bangla

জাবিতে পুলিশের হামলায় আহত ১৫০

Ny Bangla

বাংলাদেশে পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা

Ny Bangla

সময় টিভির এমডিকে অপসারণের অপচেষ্টা

Ny Bangla

আওয়ামী লীগ সরকারের কৃতিত্ব ছিনতাইয়ের চেষ্টায় উপদেষ্টা ফাওজুল

Ny Bangla

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Privacy & Cookies Policy