New York Bangla Life
বাংলাদেশ

আওয়ামী লীগ কর্মীরা ভবিষ্যৎ নিয়ে দিশেহারা

সরকার পতনের পর থেকে তৃণমূলের শীর্ষ থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এক অর্থে উধাও। গোপনে সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা বলেন, ‘আগে বাঁচা মরা, পরে রাজনীতি’। এ যেন আকাশ থেকে মাটিতে পড়ার মতো! কিন্তু দুই মাস আগেও রাজনীতিতে দলটির একচেটিয়া আধিপত্য ছিল।

এখন রাস্তায় পুলিশ না থাকলেও একদল কিশোর-তরুণের বাধায় ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে কেউ যেতে পারেনি।

প্রবল গণআন্দোলনের কারণে ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে যাওয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা মামলা, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তার ও আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে বিচারের উদ্যোগ, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের রিমান্ডে নেওয়া, এমনকি আদালতে আইনজীবী নিয়োগ করতে না পারা এমন সব ঘটনা এখন ঘটছে।

টানা দেড় বছর ক্ষমতায় থাকার পর সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে ৩৬ দিনের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা দলটি বিপর্যয়ের মুখে পরে।
প্রথমবারের মতো আন্দোলন প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে দলের লুকিয়ে থাকা শীর্ষ নেতারা দুই সপ্তাহ ধরে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কোনো নির্দেশনাও পাঠাননি।

বেপরোয়া হামলার মুখে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা সম্পূর্ণ ভেস্তে গেছে, নেতা-কর্মীরা দিশেহারা, একসঙ্গে বসার মতো নেই কোনো অফিস, প্রায় সব পুড়ে গেছে।

তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও বিভক্ত, পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পরও তারা গোপালগঞ্জ ছাড়া আর কোথাও সক্রিয় হতে পারছে না।

একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরও এই প্রতিকূল পরিবেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা ও রাজপথের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।

তবে দলের একজন সাংগঠনিক বলেন, তারা আশা ছাড়ছেন না। আর অতীত অভিজ্ঞতাই তার আশার কারণ।

“১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও বহু বছর দেশে আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর নাম কেউ উচ্চারণ করতে পারেনি। জাতীয় চার নেতাসহ বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। অনেককে দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকতে হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে এটা আবার ঘুরেছে, আবার দাঁড়াবে।”

আওয়ামী লীগের এই নেতা দেশে থাকলেও নিরাপত্তার কথা ভেবে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান।

একের পর এক মামলা

গত ১৪ আগস্ট আইনি উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, জুলাইয়ে সংঘাতে মৃত্যুর বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হওয়ার কথা ।

একই দিনে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তদন্তের আবেদন জমা দেওয়া হয় এবং সেই আবেদনও প্রসিকিউশন শাখা গ্রহণ করে।

শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেন, এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।

এই ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর চূড়ান্ত বিচার শেষে মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী এবং রাজাকার বাহিনীর সদস্য আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

দল হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও আইনে সংগঠনটির শাস্তির বিধান না থাকায় সে উদ্যোগ এগোয়নি, আওয়ামী লীগ সরকার আইন সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও উদ্যোগ নেয়নি।

ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়েরের আগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো হত্যা মামলা হয়। কোটা আন্দোলনের মধ্যেই ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় এক দোকান মালিকের মৃত্যুর ঘটনায়ও মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।

এরপর ঢাকায় একাধিক, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, নাটোর, জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন জেলায় একাধিক হত্যা মামলা রয়েছে। ঢাকায় অপহরণের একটি ঘটনাও হয়েছে।

এসব মামলা নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য আসছে না, যদিও ১৪ আগস্ট সজিব ওয়াজেদ জয়ের মাধ্যমে শেখ হাসিনা বিবৃতি দিয়েছেন, এসব মামলা নিয়ে তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

তবে এসব মামলায় পাত্তা দিচ্ছেন না ক্ষমতাচ্যুত দলের সাংগঠনিক সম্পাদক।

তিনি বলেন, “নেত্রী এরশাদ আমলে জেল খেটেছেন, ১/১১ তেও জেল খেটেছেন। মামলা, হামলা করে আওয়ামী লীগকে দমিয়ে রাখা যাবে না। নেত্রী জামায়াতের বিচার করেছেন, এখন সুযোগ বুঝে তার প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তবে সময় মত নেতাকর্মীরা ঘুরে দাঁড়াবে, সব ষড়যন্ত্র রুখে দেবে।”

কিন্তু এই মুহূর্তে দলের কোনো তৎপরতা নেই কেন- এই প্রশ্নে আত্মগোপনে থাকা এক সদস্য বলেন, “নেত্রী আমাদের কোনো দিক নির্দেশনা দিয়ে যাননি, করণীয় কিছু বলেননি।”

ছিন্নভিন্ন দল

সরকারি চাকরিতে কোটা আন্দোলন অবশেষে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেওয়ার দ্বিতীয় দিনেই পদত্যাগ করে ৫ আগস্ট দেশত্যাগ করেন শেখ হাসিনা।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার জন্য ৪৫ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল। তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ রেকর্ড করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সুযোগ পাননি।

ওই দিন কোটা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকার পতনের দাবিতে ‘মার্চ ফর ঢাকা’ কর্মসূচির ডাক দেয়। আগের রাতে কারফিউ জারি করা হয়।

পরদিন সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করতে দেয়নি পুলিশ। যাত্রাবাড়ী থেকে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু উত্তরায় মানুষের সমাগম হয়। এদিকে, কথা এসেছে যে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দুপুরে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন, সরকার পতনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সেনাপ্রধান এসে বলেন, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়েছেন, দেশ পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে।

এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, দলীয় নেতাকর্মী এমনকি সমর্থকদের বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

একটি হোটেলে আগুনে নিহত হন ২৪ জন, কোনো বাড়িতে ৭ জন, কোথাও ৬ জন, কোথাও ৩ জন বা কোথাও ৪ জনের মৃত্যুর খবর আসে।

একটি হোটেলে অগ্নিকাণ্ডে ২৪ জন, একটি বাড়িতে ৭ জন, কোথাও ৬ জন,কোথাও ৩ জন বা কোথাও ৪ জনের মৃত্যু হয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি-৩২-এর বাসভবন পুড়িয়ে ফেলা হয়, সারাদেশে তার ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ভেঙে ফেলা হয়।

এই গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ আওয়ামী লীগকে বহু বছর পিছিয়ে দিয়েছে বলে মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।

দলীয় সভানেত্রীর ‘ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করার প্রতিবাদে’ বিরুদ্ধে সোচ্চার একমাত্র গোপালগঞ্জ। বিশাল সমাবেশ হয়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত কয়েকটি এলাকায় মিছিলের খবর পাওয়া যায়।

৩৬ দিনের আন্দোলনে সাড়ে ১৫ বছরের দাপুটে শাসনের অবসানের পর কয়েকদিন বক্তব্য রাখেন শেখ হাসিনার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়। কিন্তু দিন দিন তার বিভিন্ন বক্তব্যে কর্মীদের বিভ্রান্তি বাড়তে থাকে।

শেখ হাসিনা ভারতে যাওয়ার পর বিবিসিকে জয় বলেন, তার মা আর রাজনীতিতে আসছেন না।

সেদিন তিনি বলেন, “আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে তিনবার ক্যু হল, সব কিছু হারিয়ে বিদেশে থাকতে হল। আাদের মা বাদে আমরা সবাই তো অনেকদিন ধরে বিদেশে আছি। এখানে আমরা সেটেলড, অভ্যস্ত। আমাদের এখাকার জীবনে কোনো অসুবিধা নাই। আমরা এখানে থাকতে অভ্যস্ত।”

হামলার মুখে সারাদেশে পালিয়ে আসা নেতাকর্মীরা বিজয়ের এ বক্তব্যে আরও হতাশ হন।

পরে অবশ্য জয় বলেন, তিনি রাজনীতিতে আসতে এবং দলের নেতৃত্ব নিতে প্রস্তুত, নির্বাচন দিলেই শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন, তিনি ভারত যাওয়ার আগে পদত্যাগ করেননি, ইত্যাদি।

আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, “আগামী অন্তত ১০ বছরের জন্য আওয়ামী লীগকেই রাজনৈতিকভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি ঠেলে দেওয়া হয়েছে।”

ওবায়দুল কাদের কোথায়

শেখ হাসিনার অবস্থান জানা গেলেও দলের মহাসচিব ওবায়দুল কাদের কোথায় আছেন তা জানা যায়নি। নোয়াখালীতে তার গ্রামের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

হঠাৎ তিনি বললেন, “আমি বাইরে যাচ্ছি।”

ওইদিন বিকেলে যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে সামস পরশের বাসায় বৈঠকে বসেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনসহ শেখ পরিবারের নেতারা।

যুবলীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, “রবিবার রাতেই তারা দেশ ছাড়েন।
শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দেশ ত্যাগ করেন আরও কয়েকজন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য। কিন্তু কেউ কেউ বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা আটক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজ মাহমুদকে।

যশোরে কাদেরকে আটকের গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।

একই দিনে শেখ হাসিনা সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরদিন তাদের ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ড আবেদনে তারা আইনজীবী নিয়োগের সুযোগও পাননি।

পরে বিলুপ্ত সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু এবং ক্ষমতাচ্যুত সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককেও গ্রেপ্তার করা হয়।

দুশ্চিন্তা ‘বেঁচে থাকা নিয়ে’

আওয়ামী লীগের আরেক সদস্য বলেন, “নেত্রী এই দেশটাকে গড়েছেন, যাওয়ার আগে অবশ্যই জাতির উদ্দেশে এবং দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে কিছু বলে যেতেন, হয়ত সময় পাননি।”

দল চলবে কীভাবে সে বিষয়ে আরেক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, “বাঁচব না কি মরব এর কোনো গ্যারান্টি নাই, আপনি আছেন দল নিয়ে। দেখেন না যেখানে আওয়ামী লীগ পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই হত্যা করে যাচ্ছে। দোয়া করেন যেন বেঁচে থাকি, তাহলে বহু কিছু করা যাবে। আওয়ামী লীগ নেতারা এখন দল নিয়ে নেই। আছে বাঁচা মরার লড়াই নিয়ে।”

আরেক নেতা বলেন, “সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত, কেউ রেহাই পাচ্ছে না, যেখানে যাকে পাচ্ছে পিটিয়ে, কুপিয়ে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। বাঁচলে রাজনীতি, বাঁচার সুযোগ দেয় কিনা, সেটাই এখন বিষয়।“

বেপরোয়া হামলা-লুটপাট

সরকার পতনের বিকালেই ভোলার চরফ্যাশন উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতির বাড়িতে হামলা হয়। তাকে রাস্তায় নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
জাহাঙ্গীরের প্রতিবেশী বলেন, “হঠাৎ করে কয়েকশ লোকজন বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করেন তাকে। তখন বাড়ির অন্যলোকজন বাড়ি থেকে বের হতে হতেই কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা। পরে ডুপ্লেক্স বাড়টিতে আগুন লাগিয়ে দেয়।”

৫ অগাস্ট দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকার কামরাঙ্গীরচর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি নদী পার হয়ে অন্য কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান। তাকে মারধর করে গলায় রশি বেঁধে পানিতে চুবিয়ে দেওয়া হয়।

কামরাঙ্গীর চর ঘাটের লোকজনের কাছ থেকে খবর পেয়ে তার খোঁজ পায়নি পরিবার। পরে অনেক দূরে তিনি ভেসে উঠেন। তিনদিন পর তার পরিবার এই কথা জানতে পারে।

একই অবস্থা সারা দেশের জেলা থানা পৌরসভা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগসহ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও।

৫ অগাস্ট লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদকের বাসায় মিছিল নিয়ে এসে আগুন দেওয়া হয় । বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর সেখান থেকে ৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

নাটোর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্যের বাসভবন জান্নাতি প্যালেসে আগুন দেয়ার পর সেই বাড়ি থেকে চার জনের মরদেহ উদ্ধার হয়।

সিলেটে সরকারি স্থাপনা ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন, মৌলভীবাজার-২ আসনের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, সুনামগঞ্জ-১ আসন থেকে গত নির্বাচনে নির্বাচিত রণজিত চন্দ্র সরকার, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বাসভবন ও নগরভবনে হামলা হয়।

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সহিংসতায় ঢাকার সাভার ও আশুলিয়ায় ৩৩ জনের নিহতের খবর পাওয়া যায়।

আন্দোলনকারীরা সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই থানায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। সরকারি ভবন, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বাসা-কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া যায়।

যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মালিকানাধীন হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনাল অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এক বিদেশিসহ ২৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের নাকনা গ্রামে ও সদর উপজেলার বৈকারি গ্রামে হামলায় ১৪ জন নিহত হন।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন গাজী গ্রুপের কারখানা ও গুদাম লুট হয়। এই ছিনতাইয়ে তাদের অন্তত এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয় বলে জানান দলটির এক কর্মকর্তা।


প্রতিবাদী গোপালগঞ্জ আওয়ামীলীগ

শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর শুধু গোপালগঞ্জেই বিক্ষোভ করতে পারে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এমনকি দলীয় প্রধানকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকারও করেছেন তারা।

সরকার পতনের তৃতীয় দিন বুধবার দুপুর ১২টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর তারা এই শপথবাক্য পাঠ করেন।

সবাই বলেন, “আমি শপথ করছি যে, যতদিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের মাটিতে ফিরিয়ে না আনবো ততদিন পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরে যাবো না।

“আমি আরো শপথ করছি যে, তার উপর ঘটে যাওয়া সকল প্রকার অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবে। আজ থেকে আমাদের আন্দোলন শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা। আমি এই শপথ বাক্য বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ ছুঁয়ে করছি। আমাদের এই শপথ মহান রব্বুল আলামীন কবুল করুক। আমিন, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।”

এরপর থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত লাগাতার বিক্ষোভ চলে। মাদারীপুর, ময়মনসিংহ, বরগুনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালীসহ আরও কয়েকটি জেলায় বিক্ষোভ হয়েছে, কিন্তু গোপালগঞ্জের মতো বিক্ষোভ তেমন জোরালো হয়নি।

নতুন সরকার কী ভাবছে?

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর, স্বরাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন ১২ অগাস্ট ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে ‘বিশৃঙ্খলা’ না করে দলকে সংগঠিত করার পরামর্শ দেন। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তার বক্তব্যকে ‘প্রচেষ্টা’ হিসেবে দেখিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে। চারদিন পর এম সাখাওয়াত হোসেনকে অফিস থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরার পরামর্শ দিয়ে সাখাওয়াত বলেন, “আপনি ভালো থাকেন, আবার আসেন। আমরা সবাই আপনাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু গণ্ডগোল পাকানোর মানে হয় না, গণ্ডগোল পাকিয়ে তো লাভ হবে না। এতে লোকজন আরো ক্ষেপে উঠবে।”

আর আওয়ামী লীগ নেতাদের তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ একটি বড় রাজনৈতিক দল। সে দলে প্রচুর ভালো ভালো নেতা আছে, আমি এখনই নাম বলতে পারি। এ দলটা একসময় বাঙালিদের সেক্যুলারপন্থি দল ছিল। বাঙালি আপার ক্লাস মুসলিম লীগে ছিল, আর মিডল ক্লাসের দল ছিল আওয়ামী লীগ।

“এতবড় মানুষের দল, যিনি এদেশ স্বাধীন করেছিলেন, এতে তো কোনো সন্দেহ নাই। কারো সন্দেহ থাকার কথা না। উনি (বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান) স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছেন, উনার নামে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, স্বাধীনতা হয়েছে। সে দল এরকমভাবে ভেঙে পড়ে যাবে! যে দলের লোক এখন লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি উনাদেরকেও কথা দিচ্ছি। আপনারাও দল গুছিয়ে নেন। আপনাদের দলকে কেউ তো নিষিদ্ধ করেনি।”

একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সরকার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমাবেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।

ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “আজকে উপদেষ্টাদের কেউ কেউ ‘খুনিদেরকে’ পুনর্বাসন করার বক্তব্য দিচ্ছেন। আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই, ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আপনি উপদেষ্টা হয়েছেন। সুতরাং যখন কোনো বক্তব্য দেবেন, আপনার সামনে যেন ৫ অগাস্টের গণভবনের চিত্রটা যেন মাথায় থাকে।

“যারা স্বৈরাচারকে পুনর্বাসন করতে চায়, ‘খুনি’ হাসিনাকে পুনর্বাসনের মত বক্তব্য দিতে চায়, আমরা ছাত্র-জনতা যেভাবে তাদেরকে উপদেষ্টা বানিয়েছি, ঠিক একইভাবে গদি থেকে ছুড়ে নামাতে দ্বিধা করব না।”

এরপর গত শুক্রবার উপদেষ্টা পরিষদের নতুন চার সদস্যের দায়িত্ব বণ্টনে সাখাওয়াতকে স্বরাষ্ট্র পদ থেকে সরিয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়।

এর মধ্যে ১৪ অগাস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ‘জুলাই গণহত্যার’ বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

তিনি বলেন, “সাবেক সরকারের সরকারপ্রধানসহ অন্য যারা জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, যাদের আদেশ নির্দেশ থাকার অভিযোগ রয়েছে, আমরা পত্রপত্রিকায় কিছু মন্ত্রীর নাম দেখেছি। আমরা এখানে কোনো ছাড় দেব না। আমরা বিদায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদেরও যদি কমান্ড রেসপনসিবিলিটি থাকে, আমরা সেটা পর্যন্ত খতিয়ে দেখব।”

Related posts

হাসিনার ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাতের ঘটনা প্রত্যাখ্যান রোসাটমের

Ny Bangla

গণঅভ্যুত্থানে ১ হাজার ৫৮১ জন নিহতের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ

Ny Bangla

বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে হিন্দুদের বারবার শঙ্কায় পড়তে হয় কেন?

Ny Bangla

অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হলে দেশের মানুষকে ভুগতে হবে: নুরুল হক

Ny Bangla

‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে পুলিশের বাধা

Ny Bangla

বাংলাদেশ-মিয়ানমার : দুই নোবেল বিজয়ী ইউনূস-সূচীর পরিণতি কি একই গন্তব্যে?

Ny Bangla

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Privacy & Cookies Policy