প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস দাবি করেছেন, শেখ হাসিনাকে সমর্থন করায় হিন্দুরা হামলার শিকার হচ্ছে। আবার তিনি এও দাবি করেছেন, রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে কেউ নিপীড়নের হুমকিতে নেই। ওদিকে প্রায় দিনই আওয়ামী লীগ বা সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের হত্যার খবর আসছে।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস অ্যামেরিকা সফর নিয়ে দেশের সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবেন কিনা, সেটি নিশ্চিত না। তবে ইদানীং বিদেশি সংবাদ মাধ্যমকে দেদার সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, প্রায় প্রতিদিনই তার ভাষ্য আসছে তার দেওয়া বক্তব্যের ভিত্তিতে।
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই ধরনের প্রশ্ন, কিন্তু বিস্ময়কর হল, একই প্রসঙ্গে ইউনূসের বক্তব্য দুই সংবাদ মাধ্যমে দুই রকম। কোনটা সত্য বলে ধরবে মানুষ তা বোঝা মুশকিল।
একটি সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউনূস দাবি করেছেন, হিন্দুরা হিন্দু বলে আক্রান্ত হননি, আওয়ামী লীগ সমর্থন করেন বলে আক্রান্ত হয়েছেন। আরেকটি সংবাদ মাধ্যমকে আবার বলেছেন, রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে কেউ নিপীড়নের হুমকিতে নেই।
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে অ্যামেরিকার সংবাদমাধ্যম এনপিআরের মুখোমুখি হন ইউনূস। তাকে ৫ আগস্ট থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বেপরোয়া আক্রমণ নিয়ে প্রশ্ন রাখা হয়। যথারীতি তা উড়িয়ে দিলেও ইউনূস যে কথাটি বললেন, সেটি হামলার বৈধতা দেওয়ার নামান্তর হয় কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক উঠা স্বাভাবিক।
এনপিআরের প্রশ্নে ইউনূসের জবাব ছিল, ‘আপনি যখন বলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হচ্ছে, সেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায় শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সুতরাং আপনি আলাদা করতে পারবেন না যে, তারা শেখ হাসিনার অনুসারী হওয়ার কারণে তাদের ওপর হামলা হয়েছে, নাকি তারা হিন্দু বলে তাদের ওপর হামলা হয়েছে।’
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বেপরোয়া আক্রমণ শুরু হয়। ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিতে দেশে এসে ইউনূস প্রথমে বলেছিলেন, এখন থেকে কেউ কারও ওপর হামলা করবে না।
কিন্তু হামলাগুলো যখন চলতেই থাকে, তখন অস্বীকারের পথে যায় সরকার। যখন ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন শহরে বড় বড় বিক্ষোভ হচ্ছিল, সে সময় বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করেন ইউনূস। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ফোনও করেন, বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন করতে সাংবাদিক পাঠানোর অনুরোধও করেন।
এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে দৃশ্যত সমর্থন দেওয়া প্রধান আলোই প্রকাশ করে ১ হাজার ৩৮টি বাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে।
সম্প্রতি খোদ ঢাকা শহরের উত্তরায় একটি মাঠে পূজা করতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে মিছিল হয়েছে, রংপুরে একটি স্কুলে হিন্দু ছাত্রীদেরকে কোরআন মুখস্থ করার পাশাপাশি হিজাব পরতে চাপ দেওয়ার খবর এসেছে, সে সময় ইউনূস আবার অতিরঞ্জিত প্রচারের দাবি করলেন।
অথচ অ্যামেরিকা সফরেই নিউ ইয়র্ক টাইমস ‘ক্লাইমেট ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক ওই অনুষ্ঠানে গিয়ে ইউনূসের বক্তব্য ছিল উল্টো। সেখানেও তিনি হিন্দুদের ওপর হামলা, বাংলাদেশে পিটিয়ে হত্যার যে ধুম পড়েছে, সেসব বিষয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হন।
সেই প্রশ্নে দুটো কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা –
১. বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে এখন আর কেউ নিপীড়নের হুমকিতে নেই।
২. বাংলাদেশে ‘স্ট্রিট জাস্টিস’ (মব ভায়োলেন্স) হচ্ছে না, এ বিষয়ে যে প্রচার সেটি অতিরঞ্জিত।
প্রশ্ন হল নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেয়া বক্তব্য সঠিক নাকি এনপিআরকে দেওয়া বক্তব্য সঠিক? এক জায়গায় বলেছেন, রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে কেউ নিপীড়নের হুমকির শিকার হচ্ছেন না কেউ, আরেক জায়গায় বলেছেন, শেখ হাসিনার অনুসারী বলে আক্রমণের শিকার হিন্দু সম্প্রদায়।
সেপ্টেম্বরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইউনূস যদিও দাবি করেছেন, দেশের সংবাদ মাধ্যম স্বাধীন, তাদেরকে যেন খোলা মনে সমালোচনা করা হয়, কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন। ফলে তার এই দ্বিমুখী বক্তব্য নিয়ে বাংলাদেশের কোনো সংবাদ মাধ্যমে কোনো প্রতিবেদনই নেই।
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও ইউনূসের বক্তব্যও পরস্পরবিরোধী। সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের মাটিতে তার টেস্ট ক্যারিয়ারের ইতি ঘটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার পতনের পর তার বিরুদ্ধেও হয়েছে হত্যা মামলা। তিনি চেয়েছিলেন, সরকার তাকে নিরাপত্তা দেবে।
কিন্তু আসিফ মাহমুদ ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে যা বললেন, সেটা হল, এটি সরকার করবে না। তিনি সাকিবের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতে বলেছেন। অর্থাৎ গত সংসদ নির্বাচনে সাকিব আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন, এটি তাকে নিরাপত্তা দিতে না চাওয়ার কারণ।
ড. ইউনূস যে বারবার পিটিয়ে হত্যা, হামলা, নির্যাতনের ঘটনাগুলো অতিরঞ্জিত বলছেন, আসলেই কি তাই?
মহানবী (স.) কে ভারতে কটূক্তির অভিযোগ এনে ধর্মীয় বক্তা গিয়াসউদ্দিন আত তাহেরী মানববন্ধন করতে চেয়েছিলেন তার নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কিন্তু আকিদাগত বিরোধ আছে, এ কারণে কওমি পন্থিরা তা বানচাল করেছে, পুলিশ প্রশাসন তাহেরীর কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে, পরে তাহেরীর ওপর হামলা হয়েছে।
পিটিয়ে হত্যা রেওয়াজে পরিণত হয়ে যাচ্ছে, প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা হচ্ছে, প্রতিপক্ষের হাত কেটে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেছে, আসামিকে গ্রেপ্তারে চেষ্টাটুকুও নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঘটনা ছাড়া পিটিয়ে হত্যার অন্য ঘটনাতেও পুলিশের গা ছাড়া মনোভাব।
তবে পিটিয়ে হত্যা বা ‘মব জাস্টিস’ নিয়ে এক প্রশ্নে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে ইউনূস বলে এসেছেন, “এ বিষয়ে আপনারা বাইরে থেকে অতিরঞ্জিত খবর পাচ্ছেন। যা ঘটছে সেটাকে বাড়িয়ে বলা হচ্ছে।”
আসলে কি বাড়িয়ে বলা হচ্ছে নাকি যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তার কমই আসছে সংবাদ মাধ্যমে?
সাভারে সুফি মতবাদে বিশ্বাসী এক আলেমের বাড়িতে ঘোষণা দিয়ে মাইকে হামলা হয়েছে, সেই আলেম ফেসবুক লাইভ করেছেন, সেই লাইভ ইউনূসের বিশেষ দূত মাহফুজ আলম দেখেছেন বলে প্রমাণ মিলেছে, কিন্তু কয়েক ঘণ্টাতেও যায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলায় নির্মাণাধীন বাড়িতে এক আওয়ামী লীগ নেতার ঝুলন্ত মরদেহ পাওয়া গেছে। মৃত নজরুল ইসলাম ঢালী খাদেরগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি এলাকায় একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার শরীরের একটি পায়ের উপরের অংশে ছ্যাঁচড়ানো দাগ রয়েছে।
নোয়াখালী সদর উপজেলায় আবদুস শহিদ নামে এক যুবলীগ নেতাকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সেই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে। এসব ঘটনা কিন্তু একটি দুটি না। আর এগুলো গত দুই থেকে তিন দিনের কাহিনি।