আলি শরিয়তি, লেখক
পুলিশ সদর দপ্তরসহ দেশের প্রায় সকল থানা ও পুলিশি প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। থানাগুলো লুট করে অস্ত্রসহ যাবতীয় মালামাল হয় নিয়ে গেছে অথবা নষ্ট করেছে আন্দোলনকারীরা। নিহত ও আহতের সঠিক সংখ্যা এখনও প্রকাশ করা হয়নি। ৪৫০টির বেশি থানা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুন দিয়ে সকল ডকুমেন্টস পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
এমন ভয়াবহ ও আক্রান্তের শিকার হবার পরিস্থিতিতে পুলিশের নিম্নস্তর থেকে কর্মবিরতির ডাক দেয়। মিডিয়ায় দেখেছি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা রাজারবাগ গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বিচার ও নিরাপত্তার আশ্বাস দেয় কর্মবিরতি প্রত্যাহার করান। কিন্তু কয়েকদিন পরেই কর্মবিরতির ডাক দেয়া দুজন পুলিশ সদস্য শোয়াইবুর রহমান ও সজিব সরকারকে গ্রেফতার করা হয়, তথ্য প্রযুক্তি আইনে।
যে আইনের বিরুদ্ধে ছিল এই সরকারের অবস্থান এবং পরে সরকারও এই আইন বাতিলের পথে এগিয়েছে। ইতোমধ্যে এই আইনে গ্রেফতার সবাইকে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছে সরকার। কিন্তু পুলিশের দুজন সদস্যকে মুক্তি দেয়া হয়নি। কেন?
পুলিশের শীর্ষ পদে ব্যাপক রদবদল করেছে। এসপি, ওসি, এসআই পদেও ব্যাপক ঘুরাণ্টি বদলি চলছে। চাকরিচ্যুতি, বরখাস্ত, অবসর, মামলা, গ্রেফতার নিত্য ঘটনা। এরশাদের আমলে মন্ত্রীরা অফিসে যাবার আগে পত্রিকা পড়ে দেখতেন চেয়ার আছে কিনা। বর্তমান পুলিশেও একই অবস্থা। সৈনিক থেকে আইজিপি সবাই অফিসে যাবার আগে খোঁজ নেয়, চেয়ার আছে না গেছে।
২০০১ সালের বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও এমন বদলির ঘটনা ঘটেছিল। পরে জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতায় এসে বদলির মতো লঘু কাজে সময় নষ্ট না করে চাকরি নট করেছিল অনেক শীর্ষ অফিসারের। যাদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তখন মুক্তিযোদ্ধা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও গোপালগঞ্জ বাড়ি, এরকম সিপাই থেকে অফিসার, সবাইকে গুরুত্বহীন পোস্টিং, বিভাগীয় মামলা, সুপারসিড ইত্যাদি হরহামেশা ঘটেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার আরও একধাপ এগিয়ে অনেক অফিসার ও সৈনিকের নামে খুনের মামলা দিয়ে গ্রেফতারও করছে। ইতরবিশেষ নিয়ে গঠিত এই সরকার ইতোমধ্যে মামলাবাজ হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে।
সারদায় ট্রেনিংরত কয়েক শ সাব-ইন্সপেক্টরকে বহিস্কারের প্রক্রিয়া চলছে। বেছে বেছে গোপালগঞ্জ, হিন্দু ও আওয়ামী লীগ পরিবারকে এই তালিকাভুক্ত করছে। আগামী ১ নভেম্বর যাদের পাসিং আউট হবে, তারা এখন অন্ধকার ভবিষ্যতের চিন্তায় বিধ্বস্ত।
সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো পুলিশের ওপরে আক্রমণ, শারীরিক ও মানসিক আক্রমণ, কথার অগ্নিবাণে দগ্ধ করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নিরাপত্তার হুমকিতে আছে সকল থানার পুলিশ সদস্যরা। আবার থানায় পুলিশের চেয়ার দখল করেছে স্থানীয় জামায়াত-বিএনপি-সমন্বয়ক ইত্যাদি গোত্রের লোকেরা। এরকম নিউজ পত্রিকায় বেরিয়েছে। বেনামি, যাকে খুশি তাঁকে আসামী করে মামলা নেবার জন্য চাপ প্রয়োগ, পুলিশের কাঁধে বন্দুক রেখে মামলা বাণিজ্য, গ্রেফতার বাণিজ্য চলছে সারাদেশে। ভীতসন্তস্ত্র পুলিশ নিরুপায়। আবার উপরের দিকের শীর্ষ কর্তারা ব্যস্ত এনজিওগ্রাম সরকারের মন মজিয়ে চলায়। অধস্তনদের সুবিধা-অসুবিধা ও নিরাপত্তার বিষয়ে তাঁদের ভ্রুক্ষেপ নেই। পুলিশের এই নিরাপত্তাজনিত সংকট কাটাতে গণগ্রেফতার ও গণমামলায় লেনদেনের সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু এতেও জীবনের নিরাপত্তায় শঙ্কিত পুলিশ বাহিনীর মনোবল ফিরে আসেনি। আসবেও না আর।
৫ আগস্টের আগের ও পরের ঘটনাসমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, প্রতিটি থানা ভাঙচুরের সময় গেইটের কাছেই সেনাবাহিনীর সদস্য উপস্থিত ছিল, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের সময়েও অদূরেই তারা দাঁড়িয়েছিল। অজানা কারণে তারা থানাগুলো রক্ষা করেনি। অথচ রক্ষা করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। এমনকি রক্ষা করতে বলপ্রয়োগেরও প্রয়োজন ছিল না, সেনাবাহিনীর মৌখিক নিষেধেই উম্মত্ত জনতা থেমে যেতো। তখনকার পরিস্থিতি পুলিশের জন্য যতটা প্রতিকূলের ছিল, সেনাবাহিনীর জন্য ঠিক ততটাই অনুকূলে ছিল। তারপরেও রক্ষা করা হলো না কেন?
কয়দিন আগে সরকার নির্দেশ দিয়েছে আন্দোলনকারীদের কোন বিচারের মুখোমুখি করা যাবে না। মূলত ইনডেমনিটি দিয়েছে, যা ১৯৭৫ সালের পরেও একবার এদেশে চেপে বসেছিল। ইনডেমনিটি নামক অমানবিক দানব আবার ফিরে এসেছে দেশের বুকে। অন্যদের কথা আরেকদিন, জুলাই-আগস্টে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে পুলিশ বিভাগ। যা মূলত রাষ্ট্রের ক্ষতি। অথচ খুনসহ কোন অপরাধেরই বিচারই পাবে না পুলিশ। একটি সভ্য রাষ্ট্রে এটা কল্পনাও করা যায় না।
অথচ পুলিশের বিচার ঠিকই করা হবে, কঠোর বিচার করা হবে। অনেকেই গ্রেফতারও হয়েছে। সাবেক আইজিপি থেকে সিপাই পর্যন্ত গ্রেফতারের তালিকায় আছে। এখানেও বাণিজ্য চলছে। সুবিধাবাদী সমন্বয়ক ও বড় কর্তারা যাকে খুশি বিচারের আওতায় নিচ্ছে, আর যে ‘ম্যানেজ’ করতে পারছে সে রয়ে যাচ্ছে বিচারের আওতামুক্ত। একই ঘটনা ঘটেছে আনসার সদস্যদের ক্ষেত্রে। কিছু দাবিদাওয়া ও স্বীকৃতি চাওয়ায় আনসারদের ওপরে ছাত্র নামক দানবেরা আক্রমণ চালালো। শত শত আনসারের চাকরি তো গেলোই মামলায় জেলেও নেয়া হলো। অথচ এই আনসারে পক্ষে কলম ধরে ১৯৯৪ সালে কারাবরণ করেছিলেন এনার্কিস্ট ও রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার। সেই আনসারের ওপরেই অমানবিক হামলা চালালো তাঁরই অনুগামীরা! একেই বলে এক যাত্রায় ভিন্ন ফল!
গত জুলাই-আগস্টে পুলিশসহ র্যা ব, বিজিবি এবং সেনাবাহিনীও মাঠে ছিল। বলাবাহুল্য, সরকারের পক্ষে। পুলিশ ছাড়া আর কারও বিচারের কথা কেউ বলছে না কেন? এই বিষয়ে ছাত্রনেতারা স্পিকটি নট।
অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হয়েই ঘোষণা দিয়েছিলেন বিডিআর বিদ্রোহের সঠিক তদন্ত করবেন। দুই মাস পেরিয়ে গেছে কোন উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেন? বলেছিলেন সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করবেন। সেটাও শুধু পেছাচ্ছে তো পেছাচ্ছেই। আরও কতকিছু বলেছিলেন, কত আশার বাণী শুনিয়েছিলেন। কিন্তু হায় সকল আশায় গুঢ়েবালি! দিনে দিনে প্রমাণ হচ্ছে উপদেষ্টা মহাশয় নিরেট ভদ্রলোক হলেও অতিশয় দুর্বল চিত্তের অথবা ব্যক্তিত্বহীন একজন মানুষ। দায়িত্ব নিয়েও প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না।
পুলিশ যেখানে মানুষের নিরাপত্তা দেয়, অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করে, বর্তমান সরকারের আমলে সেই পুলিশই আজকে নিরাপত্তাহীনতায় আছে। রাষ্ট্র জন্ম থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে পুলিশের ত্যাগ অস্বীকার করা যাবে না। অথচ সেই পুলিশকে পঙ্গু করে দেয়া হলো। পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেয়া হলো।
নিশ্চয়ই একদিন বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাধা হবে এবং ধ্বংসের মাস্টারমাইন্ডদের মাশুল দিতে হবে।
#আলি শরিয়তি