ইউনূস সরকার ক্ষমতায় বসলেও সংবিধান কিন্তু স্থগিত হয়নি। আর এই সংবিধান অনুযায়ী সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সমর্থন ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে সরানোর সুযোগ নেই। তিনি নিজে থেকে সরলে পদে বসবেন স্পিকার। যে স্পিকার পদত্যাগ করেছেন, তাকেই বসাতে হবে। রাজি হবে ইউনূস সরকার?
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
শেখ হাসিনা ভারতে উড়ে যাওয়ার আগে পদত্যাগ করেননি, এই বিষয়টি নিয়ে হঠাৎ করে শোরগোল। এখন ‘জোর যার, মুল্লুক তার’ এর রাজত্বে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের সুর উঠেছে।
এর আগেও যেভাবে নানা কাজ করা হয়েছে, একইভাবে আগানোর ছক স্পষ্ট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সোচ্চার হয়েছেন, এর মধ্যে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল দিয়েছেন সতর্কতা, বলেছেন, সংবিধান নাকি অপসারণের সুযোগ করে দিয়েছে।
কিন্তু আসলে কি সংবিধান অনুযায়ী এখন সেটি করা সম্ভব?
আইন ও সংবিধান নিয়ে ন্যূনতম ধারণা রাখেন, এমন যে কেউ বলবেন, ‘না’। এর কারণ হলো রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হয়, তা এই মুহূর্তে আর সম্ভব না।
একমাত্র উপায় হলো রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ। কিন্তু এরপর যে যে পদ্ধতির কথা শাসনব্যবস্থায় লেখা আছে, সেগুলো ইউনূস সরকার আর তার অনুসারীদের জন্য আরও বেশি অস্বস্তিকর হবে।
আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর নতুন সরকারের শপথের আগে সুপ্রিম কোর্টের মত নেওয়া হয়েছে, জানানো হয়েছে বঙ্গভবন থেকে। ফলে এই সরকারের আইনি বৈধতা নিয়ে আপাতত প্রশ্ন উঠছে না। ভবিষ্যতে কী হয়, সেটি পরের বিষয়।
কিন্তু ৮ আগস্ট শপথ নেওয়া মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার কিন্তু সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার অঙ্গীকার করেছে। সংবিধান কিন্তু বলবৎ আছে, এটি রদ করা হয়নি। তাহলে সংবিধানে কী লেখা, সেটি না পড়েই কি আসিফ নজরুল রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের হুমকি দিয়ে দিলেন?
আসিফ নজরুলের অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতায় পুরো বিপরীতধর্মী বক্তব্য এরই মধ্যে দেশে তাকে আলোচনার তুঙ্গে তুলে রেখেছে। ভবিষ্যতে হয়ত অন্য কোনো পরিস্থিতিতে অন্য কোনো বক্তব্য আসতে পারে।
মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ট্যাবলয়েডটির একটি ম্যাগাজিনে একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, রাষ্ট্রপতি তাকে বলেছেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্রটি তিনি দেখেননি।
অমনি শুরু হয়ে গেল। আসিফ নজরুল সচিবালয়ে ব্রিফিং করে বললেন, রাষ্ট্রপতি নাকি মিথ্যা বলেছেন এবং এর ফলে তার শপথ ভঙ্গ হয়েছে।
আরও বললেন, “উনি এই পদে থাকার যোগ্যতা আছে কিনা সে সম্পর্কে প্রশ্ন আসে।”
পরের বক্তব্যে হুমকির সুর। তিনি বললেন, “আপনার যদি শারীরিক বা মানসিক সক্ষমতা না থাকে বা আপনি যদি গুরুতর অসদাচারণ করেন, তখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে আর ওই পদে থাকতে পারেন কিনা সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার স্কোপ আমাদের সংবিধানে আছে।”
কিন্তু আসলেই কি আছে?
সংবিধানের ৫২ অনুচ্ছেদে সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করার সুযোগ আছে। ৫৩ অনুচ্ছেদে শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণেও তাকে অপসারণ করা যায়। কিন্তু সেটির জন্য সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। সেই পদ্ধতিটাও লিখিত।
রাষ্ট্রপতির অভিশংসন বিষয়ে সংবিধানের ৫২ অনুচ্ছেদে এই প্রক্রিয়াগুলো উল্লেখ আছে।
উপ অনুচ্ছেদ (১) অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে অভিসংশন করতে হলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সই নিয়ে একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের কাছে দিতে হবে। স্পিকার এই প্রস্তাব পাওয়ার ১৪ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে এটি নিয়ে আলোচনা করবেন। এ সময় সংসদ অধিবেশনে না থাকলে স্পিকার সংসদ আহ্বান করবেন।
উপ অনুচ্ছেদ ২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তদন্তের জন্য আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো যাবে।
উপ অনুচ্ছেদ ৩ বলছে, এই বিবেচনাকালে রাষ্ট্রপতির নিজের বা প্রতিনিধি পাঠানোর অধিকার থাকবে।
উপ অনুচ্ছেদ ৪ অনুযায়ী অভিযোগ-বিবেচনার পর মোট সংসদের সদস্য-সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে প্রস্তাব গ্রহণ হলে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে।
আবার রাষ্ট্রপতির যদি শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্য থাকে তাহলে কী করতে হবে, সেটি বলা আছে ৫৩ অনুচ্ছেদে।
সে ক্ষেত্রেও সংসদের অধিকাংশ সদস্যের সইসহ স্পিকারকে প্রস্তাব দিতে হবে। সংসদ তখন অধিবেশনে না থাকলে স্পিকার অধিবেশন আহ্বান করবেন।
সেই প্রস্তাব সঠিক কি না তা যাচাই-বাছাইয়ে একটি চিকিৎসা-পর্ষদ্ গঠন হবে। এরপর প্রস্তাবটির প্রতিলিপি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। তাতে ১০ দিনের মধ্যে তাকে সেই চিকিৎসা পর্ষদের কাছে পরীক্ষার জন্য উপস্থিত হতে বলা হবে।
এই প্রস্তাবটিও ১৪ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে ভোটে দেবেন স্পিকার। এ সময় সংসদ আহ্বানের প্রয়োজন হলে তিনি তাই করবেন।
এই প্রস্তাবটি বিবেচিত হওয়ার সময় রাষ্ট্রপতির উপস্থিত থাকার এবং প্রতিনিধি পাঠানোর অধিকার থাকবে।
প্রস্তাবটি সংসদে উত্থাপনের আগে রাষ্ট্রপতি পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য পর্ষদের কাছে উপস্থিত না হয়ে থাকলে প্রস্তাবটি ভোটে দেওয়া যাবে। সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে পাস হলে সেদিনেই রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে।
প্রস্তাবটি সংসদে উপস্থাপিত হওয়ার আগে রাষ্ট্রপতি পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য পর্ষদের কাছে উপস্থিত হলে সেই পর্ষদ যতক্ষণ না সংসদের কাছে মতামত পেশ করে, ততক্ষণ সেটি ভোটে দেওয়া যাবে না।
ভোটে সেই প্রস্তাবটি পাস হতে হবে সংসদের মোট সদস্যের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায়। তাহলেই কেবল রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে।
কিন্তু এই মুহূর্তে সংসদ নেই। সেটি ভেঙে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতিই। ফলে এই পদক্ষেপগুলো নেওয়ার আর সুযোগ নেই।
প্রধানমন্ত্রী তথা সরকার ছাড়াও দেশ চলেছে তিন দিন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ছাড়া কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা চলবে না। প্রধানমন্ত্রী না থাকার পর এই শূন্যতা আর অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়ে কী হবে, সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিতে পেরেছেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ বিষয়ে মতামত চাওয়ার সুযোগও নেই।
কারণ, আদালতের মতামত চাওয়ার বিষয়টি সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। সেটা হল- কোনো আইন নিয়ে যদি কোনো ব্যত্যয় বা ব্যাখ্যার দরকার হয়, বোঝা যাচ্ছে না-সেখানেই কেবল রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের কাছে মতামত চাইতে পারেন।
অর্থাৎ মতামত চাইতে হবে রাষ্ট্রপতিকেই। অন্য কারও চাওয়ার সুযোগ নেই। আর সেটি চাওয়া যাবে কেবল সাংবিধানিক শূন্যতার ক্ষেত্রে। এখানে কোনো শূন্যতাই নেই।
আবার রাষ্ট্রপতির পক্ষে ভেঙে দেওয়া সংসদ আবার পুনর্বহালের সুযোগ আছে। কিন্তু সেটি করা যাবে যুদ্ধাবস্থায়। এখন তো যুদ্ধাবস্থাও নয়।
তাহলে উপায়?
একটি উপায় অবশ্য ইউনূস সরকারের কাছে আছে। সেটি হল রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগে রাজি করানো। তিনি নিজ থেকে প্রধান বিচারপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠাতে পারবেন।
কিন্তু সংবিধানের ৫০ (১) অনুচ্ছেদেই আবার বলা আছে, উত্তরাধিকারী-কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি স্বীয় পদে বহাল থাকবেন।
সংসদ ভেঙে যাওয়া নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও আইনি বাধা তৈরি করেছে ইউনূস সরকারের জন্য।
সংবিধানেরই ১২৩ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মৃত্যু, পদত্যাগ, অভিসংশন বা অপসারণ যাই হোক না কেন, নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হবেন সংসদ সদস্যদের ভোটে।
কিন্তু সংসদেই নেই, এখন সদস্যদের ভোটে নির্বাচনের প্রশ্নই আসে না।
তাহলে পদ শূন্য হলে কী হবে, সেটি বলা আছে ৫৪ অনুচ্ছেদে।
এই অনুচ্ছেদে বলা আছে, “রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোন কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইলে ক্ষেত্রমত রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করিবেন।”
মুশকিল হল স্পিকার শিরীন শারমীন চৌধুরী গত ২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেছেন। তবে সাংবিধানিক শূন্যতার আশঙ্কার কারণেই তাকে নিরাপত্তা দিয়ে রাখা হয়েছে।
সংবিধান অনুযায়ী পদত্যাগ করাটাই স্পিকারের জন্য শেষ কথা না।
সংবিধানের ৭৪ (৬) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ক্ষেত্রমত স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তাহার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল আছেন বলে গণ্য হবে।
ফলে রাষ্ট্রপতি যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে আসলে শিরীন শারমিন চৌধুরীকে এই পদে বসানো ছাড়া বিকল্প নেই। সেটিও যদি না হয়, তাহলে গত ১৫ আগস্ট গ্রেপ্তার করা ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুকে এসে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করাতে হবে।
সেটি কি ইউনূস সরকার করতে রাজি আছেন?
সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে চাইলে সেটি হবে ‘জংলি শাসন’। এমনিতে বাংলাদেশে এখন যা চলছে তাকে ‘মবের রাজত্ব’ ছাড়া আর কীই বা বলা যায়।
এখানে উল্লেখ্য যে গত ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান অনুযায়ী এবং সংবিধান মেনে চলার অঙ্গীকার করেই শপথ নেয়। আর বর্তমানে সংবিধান বহাল আছে। তাই যা খুশি তা করার সুযোগ নেই।
যদি সংবিধানে শেষ পেরেকটি মেরে দেওয়া হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আর লেনদেনে এর কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়।