আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে দেড় মাস পেরিয়ে গেল, খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়েও বিদেশ যাচ্ছেন না। তারেক রহমান ফিরতে পারছেন না, তার বা বিএনপির নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহার হচ্ছে না। নির্বাচন দাবি করছেন মির্জা ফখরুল। কিন্তু পাত্তা দিচ্ছে না ইউনূস সরকার।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন ক্ষমতা সামনে পেয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মামলা প্রত্যাহার, সংসদ ভেঙে দেওয়া-ইত্যাদি নানা কথা তিনি বলেছিলেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করে এসে।
এর মধ্যে খালেদা জিয়ার মামলা প্রত্যাহার হয়েছে, তিনি মুক্তি পেয়েছেন, সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু নির্বাচন কবে, সেই প্রশ্নে জবাব খুঁজে মরছে দলটি।
আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাঠে নেই, এই অবস্থায় বিএনপির ‘রাজস্ব’ তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু বিএনপি দেখছে রাজস্ব তৈরি হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর। সংবাদ মাধ্যমেও বিএনপির চেয়ে জামায়াতের বক্তব্য বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, সব জায়গায় জামায়াতপন্থিদের জয়জয়কার।
নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় না এসেই নিজেদের লোকদের পদায়ন করা যাচ্ছে, এই অবস্থায় ভোট নিয়ে তাড়া নেই জামায়াতের। দলের আমির শফিকুর রহমান তো ভোট দাবি করায় বিএনপিকে ধুয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘এই সময়ে নির্বাচন, নির্বাচন, নির্বাচন জপ করলে জনগণ কবুল করবে না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, এই আলোচনার মধ্যে প্রথমবারের মতো জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সামনে এলেন। হলগুলো যে শিবিরের কর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করছেন, সেই আলামত স্পষ্ট।
ছেলেদের অনেক হলেই থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরতে না করা হচ্ছে, দোকানে দোকানে সিগারেট বিক্রিতেও নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। হাজী মো. মোহসিন হলে চারুকলার শিক্ষার্থীরা এক রুমে থেকে ভাস্কর্য তৈরিসহ নানা কিছু নির্মাণ করতেন, জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, হলে এসব চলবে না, তার তাদের এক কক্ষে থাকার ঐতিহ্যেও ছেদ পড়েছে। এগুলো কারা করছে, শিক্ষার্থীদের তা বুঝতে বাকি থাকছে না। অর্থাৎ শিবিরের নেতাকর্মীরা সবাই প্রকাশ না হলেও হলে উঠে পড়েছেন, কিন্তু ছাত্রদল পাত্তা পাচ্ছে না।
একই অবস্থা কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, ছাত্রদল ঘেঁষতে পারছে না, হলের নিয়ন্ত্রণে ছাত্রশিবির।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম কলেজে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার কারণে ছাত্রদলের পাঁচজন নেতাকর্মীকে বেদম পিটিয়েছে ছাত্র শিবিরের নেতাকর্মীরা। নিজেদের ছেলেরা আক্রান্ত, কিন্তু কেন্দ্রীয় ছাত্রদল বা বিএনপির নেতারা টু শব্দটিও করেননি।
নির্বাচন হবে হবে, এই প্রশ্নের জবাব না পেয়ে বিএনপির নেতারা এখন ভোট না হলে কী হতে পারে, সেই সতর্কতা দিচ্ছেন।
নির্বাচন নিয়ে চাপ দিচ্ছে বিএনপি
গত ১৫ আগস্ট বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথমবারের মত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বলেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যতক্ষণ গণতান্ত্রিক থাকবে, ততক্ষণ তাকে সমর্থন দেবেন তারা।
এরপর ২৪ আগস্ট থেকে টানা কয়েকদিন নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করেন তিনি। ফখরুলের পাশাপাশি অন্য নেতারাও একই সুরে কথা বলেন। বিএনপি মহাসচিব এমন কথাও বলেন যে, কয়েকজন ব্যক্তির সংস্কারে তারা বিশ্বাস করেন না।
পরে অন্তর্বর্তী সরকার তার দাবি পাত্তা না দিয়ে যখন সংস্কারের কথা বলে ছয়টি কমিশন গঠন করে, তখন ফখরুল বলেন, সংস্কার করবে সংসদ।
১৬ সেপ্টেম্বর বিএনপি মহাসচিব বললেন, “যে কোনো সংস্কার, যে কোনো পরিবর্তন এটা জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব না, উচিতও না।…“সত্যিকার অর্থেই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনটা হতে হবে। এই নির্বাচনের পরেই যারা নির্বাচিত হবেন, তারা সিদ্ধান্ত নেবেন কোন পরিবর্তনগুলো দরকার।
“শুধু পরিবর্তন দরকার নাকি বাতিল করে নতুন করে লিখতে হবে, সেটা পার্লামেন্টই সিদ্ধান্ত নেবে কী করতে হবে।”
কিন্তু ইউনূস সরকার নির্বাচনের দাবি নিয়ে নিয়ে টু শব্দটিও করেনি। উল্টো তার পরদিন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পিছুটান দিয়ে বললেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হওয়া চলবে না। তিনি নেতাকর্মীদের ধৈর্য ধরতেও বললেন।
এর মধ্যে ইউনূস উড়ে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে, জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে। সে সময় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান নির্বাচনের সময় নিয়ে কথা বললেন; আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বললেন, দেড় বছরের মধ্যে যেন নির্বাচন হতে পারে, সে জন্য তিনি সরকারকে সব রকমের সহযোগিতা দিচ্ছেন।
এই প্রথম নির্বাচন নিয়ে একটি সময়সীমা পাওয়া গেছেও নিউ ইয়র্কে ইউনূস আবার সময় নিয়ে প্রশ্নে মুখে কুলুপ আঁটলেন। তিনি বললেন সেই সংস্কারের কথাই।
দেশে ফখরুল আরও অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন, ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি বললেন, ‘সংস্কার নিয়ে সময়ক্ষেপণ চলবে না। প্রশাসনের সব ইউনিটকে দ্রুত সংস্কার করে দেশকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের উপযোগী করতে হবে।’
বিএনপি নেতা ভয়ও দেখালেন। বললেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশকে ফিরিয়ে দিতে দেরি হলে অন্য কোনো ব্যবস্থা যেন ঢুকে না পড়ে সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।’
তারেকের মামলা প্রত্যাহার প্রশ্নে আসিফ নজরুলের ‘না’
কেবল নির্বাচন নয়, বিএনপির আরও দাবি আছে। তাদের দলের নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহার। বহুবার বলার পরেও ইউনূস সরকার পাত্তা দিচ্ছে না।
সরকার পতনের পর দেশে ফিরে এসেছেন অনেকেই। কিন্তু ফিরতে পারছেন না বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর কারণ, তিনি ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা বাতিল হলেও তারেকেরে ১০ বছরের সাজা বহাল, অর্থপাচার মামলাতেও তার সাত বছরের সাজা আছে, আছে ২০ কোটি টাকা জরিমানার দণ্ড। ছোটখাট আরও মামলায় সাজা আছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে মির্জা ফখরুল যে ভাষায় দাবি জানাতেন, এখনও তা জানাতে হচ্ছে।
অগণতান্ত্রিক শাসন চেপে বসতে পারে- এমন সতর্কতা জানানোর পর তিনি আরও বললেন, ‘তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে সব ‘ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা’ প্রত্যাহার করে তাকে দেশে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি দেশের সকল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেওয়া মামলাও প্রত্যাহার করতে হবে। কারণ, এসব মামলা প্রত্যাহার করা না হলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে না।’
দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের দাবি গত ১৫ আগস্ট থেকে প্রায় প্রতিটি সমাবেশে তুলছেন ফখরুল। ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকেও এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তাতেও কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না।
নেতাকর্মীরা আদালতে হাজিরা দিতে গেলে পুলিশ টাকা চায় অভিযোগ করে বিএনপি নেতা বলেন, ‘টাকা না দিতে পারলে ধরে নিয়ে যায়; মামলা দেয়।’
তারেকের মামলা প্রত্যাহার বিষয়ে সরকারের মধ্যে যে কোনো ভাবনা নেই সেটি খোলাখুলিই জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। একটি টকশোতে এই বিষয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকার কোনো ব্যক্তির একক মামলা নিয়ে ভাবছে না।
ফখরুল তার নেতাকর্মীদের জন্য দাবি আদায় করতে না পারলেও জামায়াত কিন্তু ঠিকই আদায় করে নিচ্ছে প্রকাশ্যে বক্তব্য না দিয়েই।
সরকার পতনের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই চট্টগ্রাম কারাগার থেকে চাড়া পেয়েছেন শিবিরে আলোচিত নেতা, নাছির উদ্দিন চৌধুরী যিনি শিবির নাছির নামে পরিচিত।
হত্যাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগ গ্রেপ্তার হওয়া নাছির কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন ২৬ বছর পর।
বিদেশ যাচ্ছেন না খালেদা জিয়া
বিএনপির দাবি পূরণ হচ্ছে না, এর মধ্যে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত অবস্থাতে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছেন না। অথচ ২০১৮ সালে কারাগারে যাওয়ার পর থেকে তাকে বিদেশে যেতে দেওয়ার দাবিতে অনেক কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি, পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে অনেকে নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে।
বিএনপির তরফে প্রথমে জানানো হয়েছে, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য এখন বিমান যাত্রার উপযোগী নয়। অথচ তার সঙ্গে ব্রিটিশ হাইকমিশনার সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি চেয়ারে বসে অনেকক্ষণ কথা বলেছেন। অথচ তিনি যখন হাসপাতালে শুয়ে থাকতেন, যে সময় তাকে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাবি করেই বিদেশ দিতে চেয়েছিল দল।