আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, ব্যবসা-বাণিজ্যে দুর্দশা, পোশাক শিল্প নিয়ে উৎকণ্ঠা, বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। ইউনূস বলেছিলেন, কেউ আর কারও ওপর হামলা করবে না। তবে এখন মহানবী (স.) এর জন্মদিনের আয়োজনেও হামলা হয়েছে, পিটিয়ে মারা হয়েছে।
এনওয়াই বাংলা লাইফ, বিশ্লেষণ
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হতে বাংলাদেশে উড়ে এসে গত ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘কার কেউ কারও ওপর আর হামলা করবে না।’
কিন্তু গত দেড়টি মাস ধরে দেশে যা চলছে, তা নজিরবিহীন। দখল, হামলা, হত্যা, নির্যাতনে মচ্ছব লেগেছে, সরকার কথার ফুলঝুড়ি ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না।
দেশের মাজারে মাজারে হামলা, ভাঙচুর, আগুন, এমনকি মহানবী (স.) এর জন্মদিনে ঈদে মিলাদুন্নবীর মিছিলে হামলা করে হত্যা করা হয়েছে। ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা মঈনুদ্দিন খান বাদলের কবরে।
১০ বছর আগে শিবিরের হামলায় পা হারানো ছাত্রলীগ নেতাকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করেছে শিবিরের নেতাকর্মীরা। তাদের নামটা পর্যন্ত লেখা যায়নি সংবাদ মাধ্যমে। চট্টগ্রামে এক তরুণ ধারালো অস্ত্র নিয়ে গিয়ে প্রতিপক্ষের হাত কেটে বীরদর্পে হেঁটে চলে এসেছেন, কেউ তাকে কিছু বলেনি।
প্রকাশ্যে তৎপর হয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর, কারাগার থেকে বের হয়ে গেছেন জঙ্গিসহ ভয়ংকর ৯০০ অপরাধী, পুলিশের হাজার হাজার অস্ত্র লুট হয়েছে, যৌথ অভিযানেও উদ্ধার হয়েছে অল্পই।
ইউনূস ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার কথা না শুনলে তিনি চলে যাবেন, কিন্তু এখন জেঁকে বসতে চাইছেন। সহসা নির্বাচন না দেওয়ার লক্ষণ বুঝতে পেরে বিএনপির পক্ষ থেকেও এসেছে আক্রমণাত্মক বক্তব্য এমনকি নুরুল হক নূরের গণঅধিকার পরিষদের আলোচনা সভা থেকে ধুয়ে ফেলা হয়েছে সরকারকে।
পুলিশ বাহিনীর কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার মধ্যে উগ্রবাদের বিস্তারে বাধাহীন পরিবেশ, আইনশৃঙ্খলা ও বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মধ্যে ব্যবসা ও শিল্প নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় গোটা দেশ।
প্রায় দমবন্ধ এই পরিস্থিতিতে ইউনূস সরকার সামলাতে না পেরে অবশেষে সেনাবাহিনীর হাতে বিচারের ক্ষমতা তুলে দিলেন, যা বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় বিরলই চলা চলে।
গ্রেপ্তার ও বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার মত সুযোগ দিয়ে সেনাবাহিনীকে এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
সেনা কর্মকর্তাদেরকে বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেখানে এই নির্বাহী হাকিমরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, অর্থাৎ জেলা প্রশাসকের অধীনে থাকার কথা বলা আছে।
এসব ধারায় গ্রেপ্তার ও গ্রেপ্তারের আদেশ, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করা, তল্লাশি পরোয়ানা জারি, অসদাচরণ ও ছোটোখাটো অপরাধের জন্য মুচলেকা আদায়, মুচলেকা থেকে অব্যাহতি, বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ, স্থাবর সম্পত্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বাধা অপসারণ এবং জনগণের ক্ষতির আশঙ্কা করলে সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিভিন্ন ক্ষমতা পাবেন বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।
সবশেষ বাংলাদেশে ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। এরপর নানা সময় সেনা মোতায়েন হলেও সেনা সদস্যরা কাজ করেছে বেসামরিক প্রশাসনের অধীনে থেকে।
ইউনূস সরকারের এই পদক্ষেপে স্পষ্ট হল, বেসামরিক প্রশাসন দিয়ে চালাতে পারছে না বলে এখন সামরিক বাহিনীতে ভর করেছে তারা।
তবে অতীতে যখনই সেনাবাহিনীর হাতে এই ক্ষমতা দেওয় হয় তখনই বিতর্ক উঠে, সেনা হেফাজতে প্রাণহানির অভিযোগ উঠে। ২০০১ সালে যৌথ অভিযানের পর সংসদে ইনডেমনিটি বিলও পাস করে বিএনপি-জামায়াত সরকার, যেন আইন লঙ্ঘনের ঘটনায় বিচার না করা যায়।
অথচ ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হতে দেশে এসে বিমানবন্দরে ইউনূস বলেছিলেন, ‘আপনারা যদি আমার ওপর বিশ্বাস ও ভরসা রাখেন, তাহলে নিশ্চিত থাকেন, দেশের কোনো জায়গায় কারও ওপর হামলা হবে না। এটা আমাদের প্রথম দায়িত্ব।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আর আমার কথা যদি না শোনেন, তাহলে আমার প্রয়োজন এখানে নাই; আমাকে বিদায় দেন। আমাকে প্রয়োজন মনে করলে আমার কথা শুনতে হবে।’
এরপর পেরিয়ে গেছে দেড় মাস, এমন কোনো দিন নেই যেদিন হামলা, ভাঙচুর, লুটপাটের সংবাদ আসছে না, তবে ঘটনা যত ঘটছে, সংবাদ আসছে তার চেয়ে কম।
সংবাদ মাধ্যম নিষ্ক্রিয় নাকি ভয়ে আছে, সেই প্রশ্নের মধ্যে সরকারের নির্লিপ্ততাও বিস্ময়কর। গত ৫ আগস্ট থেকে সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর করা গাজী টায়ার্স কারখানাটি চার দফা লুটপাট ও দুই দফা আগুন দেওয়ার শিকার হয়, দুইশ বা তিনশ বা চারশ বা পাঁচশ মানুষ লুট করতে এসে পুড়ে মারা যায়।
কিন্তু না স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, না শিল্প উপদেষ্টা একটি কথাও বললেন না, ঘটনাস্থল ঘুরে আসার প্রয়োজন বোধ করলেন না। যেন কোথাও কিছু হয়নি।
হঠাৎ চালের দামে লাফ, ডিম, মাছ, সবজির দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে, কিন্তু সরকারে নীরবতা। দেশের উত্তর পূর্ব ও পূর্বাঞ্চলে নজিরবিহীন বন্যায়র পর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরকারি ত্রাণ তৎপরতার লেশমাত্র নেই, শুরুতে বলা হয়েছিল পুনর্বাসন হবে, এখন পর্যন্ত তেমন কোনো পরিকল্পনাও ঘোষণা হয়নি। অথচ সরকারি হিসাবে ক্ষতি হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি।
সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিক টানা অসন্তোষের কারণে এরই মধ্যে ২০ শতাংশ অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। অভিজ্ঞতাহীন তরুণ উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার কাঁধে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মত একটি গুরু দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন গণ অধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নুর। বলেছেন, ‘সদ্য পাস করা ২৫ বছরের একজন তরুণের হাতে এই দায়িত্ব দিলে তিনি ব্যর্থ হবেনই।’
পুলিশ বাহিনীতে ইউনূস সরকার তৎপর করতে পারেননি, তবে প্রধান উপদেষ্টা কেবল সংস্কারের কথা বলে যাচ্ছেন, ছয়টি কমিশন করার ঘোষণা এসেছে।
যে বিএনপি প্রথম দিন থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে উৎফুল্ল ছিল, তারা এখন প্রশ্ন করছে সরকারকে। সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখনের আলোচনায় বিরক্তি প্রকাশ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এটা সংসদের দায়িত্ব।
এতদিন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বললেও সোমবার ঢাকায় এক আলোচনায় দ্রুত নির্বাচন চেয়েছেন বিএনপি মহাসচিব।
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে চক্রান্ত চলছে- এমন অভিযোগও আনা হয়েছে দলটির তরফে। ফখরুলের এমন অভিযোগের ভিত্তি হল রোববার প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন।
এতে লেখা হয় ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) নামে একটি সংগঠন জরিপ চালিয়ে জানতে পেরেছে ৭১ শতাংশ মানুষ মনে করে দেশ সঠিক পথে আছে।
শতকরা ৮১ ভাগ মানুষ চান যে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার সম্পন্ন করার জন্য যত দিন প্রয়োজন, তত দিন ক্ষমতায় থাকুক।
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কত দিন হওয়া দরকার? এই প্রশ্নে ৩৮ শতাংশ নাকি বলেছে ৩ বছর বা তার বেশি হওয়া দরকার। বিস্ময়কর হল এই জরিপে উঠে এসেছে ৮২ শতাংশ মানুষ নাকি বলেছে, দেশের আইন শৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে।
মির্জা ফখরুল ক্ষেপে গিয়ে বলেছেন, ‘বেশ কিছু সংগঠন ও গোষ্ঠী অন্তর্বর্তী সরকারকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাখার কথা বলছে। …এটা আমি জানি না তারা এই কথাগুলো কোত্থেকে পেল, কীভাবে পেল? কিন্তু জনগণ এটা কোনোদিন মেনে নেবে না।”
দ্রুত নির্বাচন দাবি করে তিনি বলেন, ‘এরা (অন্তর্বর্তী সরকার) এসেছেন আপাতত রাষ্ট্র পরিচালনা করার এবং নির্বাচনের ব্যবস্থা করবার জন্যে।’
মঙ্গলবার ঢাকায় বিএনপির সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘জনগণের নির্বাচনে সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ। সংসদীয় সরকার ছাড়া কোনো সংস্কার স্থায়ী হয় না। ভোটারদের নির্বাচনের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সরকার প্রতিষ্ঠা করাই এই সরকারের প্রধান লক্ষ্য।’
তবে দেশ সামলাতে না পারলেও ইউনূস সরকার এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে বুঝিয়ে দিল, নির্বাচন তাদের মাথায় নেই।