`আগে ঢাকায় রাত ১/২/৩টাতেও আরামসে ঘুরতে পারতাম, সেই ঢাকাতে এখন রাত ৯ টা বাজলে বাইরে একা ঘুরতে ভয় লাগে কে কখন পিস্তল ঠেকিয়ে ডাকাতি করে’, নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে এক তরুণ তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের নিরাপত্তাহীনতার কথা।
এনওয়াই বিডি স্পেশাল
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি যে অবস্থা, তা তার এই কথাতেই ধরা পড়েছে।
তবে সবচেয়ে করুণ অবস্থা সম্ভবত শিক্ষকদের। শিক্ষাঙ্গণ একেবারে লাগামহীন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরেছে, এমন খবর আসছে না। বরং স্কুলে, স্কুলে, কলেজে কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের হেনস্থার যে ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে, তা আঁতকে উঠার মত।
এর মধ্যে নওগাঁর হাঁপানিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নুরুল ইসলামকে অবরুদ্ধ করে টানাহেঁচড়া করতে থাকার মধ্যে তিনি পদত্যাগপত্রে সই করে স্ট্রোক করেন। তার অবস্থা সঙ্গিন, এখন তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি।
পদত্যাগ করাতে টানাহেঁচড়ার পর স্ট্রোক করেন নওগাঁর হাঁপানিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম।
হাজার হাজার শিক্ষককে এই হেনস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, সিলেটে এক শিক্ষকের মাথায় চড় দিয়ে এক কিশোরকে বীরদর্পে ঘোষণা দিতে দেখা গেছে, সেনাবাহিনীর এক অফিসারকে গিয়ে এক শিক্ষককে উদ্ধার করে আনতে দেখা গেছে, ঘিরে ধরা ছাত্রদের কাছ থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি বলছিলেন, ‘আমি আমার শিক্ষককে নিয়ে যেতে এসেছিল’।
মানুষে মানুষে সম্পর্ক আর আগের মত নেই, ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কেও সেই আগের কালের মত গুরু-শিষ্য সম্পর্ক নেই এই যুগে, তারপরেও শিক্ষকরা ছিলেন সম্মানের পাত্র। কিন্তু এই মুহূর্তে শিক্ষকরা অপমানিত, লাঞ্ছিত হয়ে কুঁকড়ে আছেন। হাজার হাজার শিক্ষক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না।
এতসব ঘটনা ঘটছে, কিন্তু সরকারের তরফে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ নিজেও একজন শিক্ষক, কিন্তু তিনি অনেকটাই নির্বিকার, যেন কোথাও কিছু ঘটছে না। তার কোনো পদক্ষেপ নেই।
অথচ গত ২৫ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ নিয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠক শেষে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে ” জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে প্রশাসন ভেঙে পড়তে পারে। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা পেতে অসুবিধা হবে।”
এরপর আরও পাঁচটি দিন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু শিক্ষক হেনস্তা থামেনি, সরকারের তরফে আর কোনো বক্তব্যও নেই।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশেই এক নৈরাজ্য চলছে। দেশের পূর্বাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে নজিরবিহীন বন্যার পর সাধারণ মানুষ দুর্গতদের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সরকার আসলে কী করছে, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
সরকারি হিসাবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৬ লাখ। তাদের জন্য ১০ দিনে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাথাপিছু সাড়ে ছয় টাকার কিছু বেশি, মাথাপিছু চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে চার কেজিরও কম।
গত ২২ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর জানানো হয়েছিল, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সব উপদেষ্টাদেরকে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেছেন। কিন্তু আটদিন হয়ে গেল, এক দুইজন দুর্গত এলাকায় গিয়ে ‘ফটোসেশন’ আর আশ্বাসের বাণী দিয়ে চলে এসেছেন।
বাস্তবতা হল ২৮ আগস্ট পর্যন্ত ১১টি জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্ধ কোটিরও বেশি মানুষের জন্য সরকারের বরাদ্দ কেবল নগদ ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা, ২০ হাজার ৬৫০ টন চাল, ১৫ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার ও গোখাদ্যের জন্য ৩৫ লাখ টাকা।
অর্থাৎ মাথাপিছু নগদ বরাদ্দ ৬ টাকা ২৮ পয়সা, মাথাপিছু চাল বরাদ্দ হয়েছে ৬ কেজি ৬৯০ গ্রাম, অথচ বন্যা ১০ দিন হয়ে গেল।
ড. ইউনূস অবশ্য বাহবা কুড়াচ্ছেন অন্যভাবে, তিনি উপদ্রুত এলাকায় যাননি, যাওয়ার আগ্রহও দেখাচ্ছেন না, তার গুণমুগ্ধরা ফেইসবুকে ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তিনি ফটোসেশন না করে ‘আসল কাজরা’ করছেন।
কিন্তু ‘আসল কাজ’ আসলে তিনি কী করেছেন? উপদেষ্টাদেরকে নিয়ে বৈঠক করেছেন বন্যার তৃতীয় দিনে, বলা হয়েছে, বন্যা মোকাবিলা হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার, তবে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওদের বৈঠক। এরপর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এক হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠনের।
এই তহবিল গঠনের পর ৮ দিনে জমা পড়েছে মাত্র ৮ কোটি টাকা, এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪০ হাজার কোটি টাকা মুনাফা থেকে ২৩ কোটি টাকা দেওয়ার ঘোষণা এসেছে।
জার্মান সমাজবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, আইনবিদ, এবং রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ম্যাক্স ওয়েবার বলেছিলেন, যখন রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে ওঠে, আইন প্রয়োগে অক্ষম থাকে, ঊর্ধ্বমুখী অপরাধ মাত্রা, চরম রাজনৈতিক দুর্নীতি, অনিয়ন্ত্রণযোগ্য ও অকর্মণ্য আমলাতন্ত্র, বিচারিক অকার্যকারিতা, রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপসহ রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির পরিবর্তে যখন স্থানীয় বা সনাতনী সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায় তখন একটি রাষ্ট্র ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হয়।
ড. ইউনূস সরকারে বসার পর সংস্কার, সংস্কার, সংস্কার, এই শব্দগুলো বারবার বলা হচ্ছে, কিন্তু সংস্কারের মানে কী তা বলা হচ্ছে না।
দেশজুড়ে চলছে হামলা, হত্যার মিছিল, লুটপাট, কিন্তু সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই। বরং পুলিশের গুলিতে নিহতের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একশটিরও বেশি মামলায় ফাঁসানো হয়েছে, আসামির তালিকায় বাদ পড়েননি যুক্তরাজ্যের এমপি ও শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকীও।
এভাবে ঢালাও মামলার ঘটনায় সমালোচনা করছে এমনকি বিএনপি ও জামায়াতও, কিন্তু স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কোনো ভাষ্য নেই, বরং মামলা করতে এলেই তা নিয়ে নেওয়ার আদেশ জারি হয়েছে।
ঢাকার পাশে নারায়ণগঞ্জে কিংবদন্তির মুক্তিযোদ্ধা গোলাম দস্তগীর গাজীর গাজী টায়ার্স কারখানায় লুটপাট ও আগুনের ঘটনায় পুড়ে আসলে কত শত মানুষ মারা গেছে, সেই হিসাব কখনও পাওয়া যাবে না, কিন্তু সরকারের একটি বক্তব্যও নেই এ নিয়ে।
সরকার পতনের পর থেকে কী হারে লুটপাট চলছে, গাজী টায়ার্স তার একটা উদাহরণ মাত্র। সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই, কোনো বক্তব্যও নেই।
এই লুটপাট চলেছে তিন থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত, মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করা হয়েছে, অবিশ্বাস্য হল প্রশাসনের তরফ থেকে তা ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ বা ন্যূনতম চেষ্টাও ছিল না।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিনও লুটপাটের শিকার হয় কারখানাটি, সেদিন গাজী ট্যাংকেও লুটপাট চালানো হয়, অবিশ্বাস্য হল, সেসব সংবাদও প্রকাশ হয়নি। এবার প্রায় দুইশ বা শত শত মানুষ পুড়ে মারা না গেলেও সংবাদ প্রচার হত কিনা, সে সংশয় রয়েছে, কারণ দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক প্রথম আলোতে সংবাদটি আসে প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরে, অন্যরা ছাপে আরও পরে।
পুলিশ থানায় ফিরলেও বাইরে নেই বললেই চলে, কেবল আওয়ামী লীগ সরকারের সদস্য বা নেতাদের গ্রেপ্তার, তাদেরকে আদালতে নিয়ে যাওয়া, ইত্যাদি ঘটনায় কিছু সদস্যদের দেখা যায়।
বাকি পুলিশ সদস্যরা বাইরে বের হচ্ছেন না, কারণ তাদের অস্ত্র লুট হয়ে গেছে, তাদের গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সরকারের তরফে কেবল কদিন পরপর অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ আসে, কিন্তু পুলিশ বাইরে যাবে কী করে, সে প্রশ্নও করতে পারছে না গণমাধ্যমকর্মীরা।
থানায় থানায় হামলা করে অস্ত্র লুটের পাশাপাশি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গাড়ি, এখন অভিযানে যাওয়ার মত অবস্তানেই নেই পুলিশ।
নিরাপত্তাহীনতায় দেশের ব্যবসা বাণিজ্য ভেঙে পড়ার দশা, সরকার পতনের পরপরই ভোল পাল্টে ফেলা ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তার অনুরোধ করে সরকার নয়, দেখা করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে, তাদের মধ্যে ছিলেন বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টুও।
বিএনপি নেতা কেন সরকারের বদলে সেনাবাহিনীর কাছে গেলেন, সরকার কি তবে অকার্যকর?- এই প্রশ্নের জবাব কিন্তু এখানেই। ম্যাক্স ওয়েবারের ‘সংজ্ঞা’ তো আছেই।