New York Bangla Life
বাংলাদেশবিশেষ প্রতিবেদন

বাংলাদেশের ঋণ কি আসলে বেশি? একটি তুলনামূলক আলোচনা


বাংলাদেশ সরকারের ঋণ নিয়ে হঠাৎ হুলুস্থুল। আওয়ামী লীগ সরকার ১৮ লাখ কোটি টাকা ঋণ রেখে গেছে শিরোনামে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে দৈনিক প্রথম আলো। এরপর শুরু হয়েছে ‘গীবত’।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারের ঋণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে এটা সত্য, তবে এই বিষয়টি যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে দেশের সর্বনাশ হয়ে গেছে।

এই প্রতিবেদনে একটি মজার লাইন লেখা হয়েছে, “অন্তর্বর্তী সরকারকে এ ঋণ পরিশোধে এখন ব্যবস্থা নিতে হবে।” এর মানে হল আওয়ামী লীগ সরকার এই ঋণ পরিশোধে কোনো ব্যবস্থা বা পরিকল্পনা রেখে যায়নি।

অথচ বাস্তবতা হল কেবল উন্নয়নশীল বিশ্ব না, উন্নত বিশ্বও প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ নিয়ে থাকে। ঋণমুক্ত সরকার বিশ্বে আছে কি না, সেটি একটি গবেষণার বিষয় হতে পারে। গুগল করলেই কিন্তু দেখা যায়, জানা যায় কোন দেশের ঋণ কত। কিন্তু এত কষ্ট করার কী দরকার?

তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন তাদেরকে মিডিয়া ট্রায়ালের সুবর্ণ সুযোগ। এখন যা খুশি লেখা যাবে, বিপক্ষে যুক্তি দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু একটি প্রতিবেদন তৈরির জন্য যে তুলনামূলক আলোচনা লাগে, সেই বিষয়গুলোও উপেক্ষিত।

এবার দেখে নেয়া যাক, বাংলাদেশের ঋণ খুব বেশি কিনা। প্রথম আলো লিখেছে, ‘অর্থ বিভাগ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশি-বিদেশি ঋণের প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে। তাতে মোট ঋণের স্থিতি দেখানো হয়েছে ১৬ লাখ ৫৯ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা।
ঋণের হিসাব হালনাগাদ করা হয় তিন মাস পরপর। মার্চ ও জুনের হিসাব আরও কিছুদিন পর তৈরি করা হবে। অর্থ বিভাগ ধারণা করছে, চলতি বছরের জুন শেষে দেশি-বিদেশি ঋণ স্থিতি দাঁড়াবে ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার মতো।’

প্রতিবেদনে আরও লেখা হয়েছে, ‘জুন মাস শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৭৯০ কোটি মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার ১১৮ টাকা দরে হিসাব করলে তা ৮ লাখ ১ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়।’

কেবল এই সংখ্যাটি জানলে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে। আবার আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি যখন সরকারের দায়িত্ব নেয়, তখন দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা।

অর্থাৎ আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদে বাংলাদেশের ঋণ ছয় গুণেরও বেশি বেড়েছে। ব্যাস আর কিছু লাগে। শুরু হয়ে গেছে ‘গেল গেল রব।’

কিন্তু আসলে কি সর্বনাশ হয়েছে? যদি নিম্ন আয়ের, উন্নয়নশীল আর উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তাহলে কিন্তু সহজেই বোঝা যায় বাংলাদেশ ঋণের ক্ষেত্রে বেশ স্বস্তিদায়ক অবস্থায় আছে।

স্বাধীনতার পর থেকেই দেশে যত বড় উন্নয়ন প্রকল্প হয়েছে, তার মধ্যে শতভাগ দেশীয় অর্থায়নে প্রকল্প হয়েছে একমাত্র পদ্মাসেতু। বাকি সব প্রকল্পেই ৯০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে, যেটি যমুনা সেতুই হোক আর হাসপাতালের বড় কেনাকাটা হোক বা জলবায়ু প্রকল্প হোক।

একটি দেশের মোট ঋণ তার সীমার মধ্যে কিনা, সেটি হিসাব করা হয় তার মোট দেশজ উৎপাদন অর্থাৎ জিডিপির কত শতাংশ, সে হিসাব করে। আগামী বছর বা তার পরের বছর এটি জিডিপির ৪৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকতে পার।

যদি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনায় যাই, তাহলে কী চিত্র দেখা যায়?

ভারতের দিকে তাকানো যাক। ২০১৯ সালে ভারত সরকারের মোট ঋণ তার দেশজ উৎপাদন অর্থাৎ জিডিপির ৭৫ শতাংশ ছিল। করোনাভাইরাস মহামারীর বছরে তা বেড়ে ৮৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। সেখান থেকে এক শতাংশের কিছুটা বেশি কমে ২০২৩ সালে দাঁড়ায় ৮৩ দশমিক ৭৫ শতাংশে।

ভারতে গত মার্চে শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের স্থিতিই দাঁড়িয়েছে ৬৬৩ বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে আছে দেশীয় ঋণ।

এই অঞ্চলে উন্নয়নে অনেকটা পিছিয়ে থাকা নেপালের ঋণ অনেকটা বাংলাদেশের মতই। ২০১৫ সালে জিডিপির সাড়ে ২২ শতাংশ ছিল সরকারের ঋণ। সেটি ধারাবাহিকভাবে বাড়তে বাড়তে ২০২৩ সালে দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশের কাছাকাছি।

২০২৩ সাল শেষে নেপালের ছোট অর্থনীতির বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার।

ভুটানের হালনাগাদ হিসাব পাওয়া যায় না। তবে ২০০৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যে হিসাব তাতে দেখা যায় ২০১০ সালে দেশটির সরকারের ঋণ জিডিপির তুলনায় ছিল সর্বনিম্ন ৫৬ শতাংশ। ২০২০ সালে তা জিডিপির ১১১ শতাংশে দাঁড়ায়।

পাকিস্তানে জিডিপির তুলনায় সরকারের ঋণ ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জিডিপির ৬৩ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৬ সাল থেকে এটি বাড়তে থাকে। সেই বছর তা দাঁড়ায় ৬৭ দশমিক ৬০ শতাংশ।

২০২০ সালে এই ঋণ জিডিপির ৯৪ শতাংশে ছাড়িয়ে যায়। সেখান থেকে কিছুটা কমে ২০২৩ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ৯১ শতাংশ।

২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে পাকিস্তানের বিদেশি ঋণেই দাঁড়িয়েছে কেবল ১৩১ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের মোট ঋণের চেয়ে কম। অথচ এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে।

এবার কিছু উন্নত দেশের দিকে তাকানা যাক। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব তেল রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ ডলার আয় করলেও দেশটির সরকার ঋণ ছাড়া চলতে পারে না। ২০২৪ সাল শেষে দেশটির মোট ঋণ দাঁড়াবে ৩০৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ হল ১২৫ বিলিয়ন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কিছুদিন পর পর নতুন ঋণ অনুমোদন না করলে দেশটি দেউলিয়া হওয়ার দশা হয়ে যায়। দেশটির ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের হিসাব বলছে, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির চেয়ে দেশটির সরকারের ঋণ বেশি। ২০২৪ সাল শেষে দেশটির মোট ঋণ দাঁড়াবে ৩৪ ট্রিলিয়ন ডলার।

এক ট্রিলিয়ন মানে এক হাজার বিলিয়ন, তার মানে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ঋণ ৩৪ হাজার বিলিয়ন। দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন ২৭ হাজার বিলিয়নের কিছুটা বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির তুলনায় সরকারের ঋণ ১২৩ শতাংশ শতাংশ শুনে ভ্রু কুঁচকে গেছে? হিসাব আরও বাকি আছে। এশিয়ার সবচেয়ে উন্নত দেশ জাপানের কথা শুনলে আরও ধাক্কা খেতে হতে পার। দেশটির জিডিপির তুলনায় ঋণের হার ২৩৬ শতাংশ। ডলারের হিসাবে তা ৯ হাজার ২০০ ডলার।

এশিয়ায় বহু মানুষের স্বপ্নের দেশ সিঙ্গাপুরের সরকারও ভীষণ ঋণগ্রস্ত। দেশটির জিডিপির তুলনায় ঋণের হার ১৬৮ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশের তুলনায় চার গুণ ঋণগ্রস্ত সিঙ্গাপুর। উন্নত এই দেশটির মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮৮৫ বিলিয়ন ডলার।

এশিয়ায় উৎপাদনের হাব চীন এখন দেশে দেশে ঋণ দিয়ে বেড়াচ্ছে, বিনিয়োগের ‍সুযোগ খুঁজছে। সেই দেশটির সরকারও বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালায়।

২০১১ সাল থেকে দেশটির সরকারের ঋণ টানা বাড়ছে। সেই বছর জিডিপির তুলনায় চীনের ঋণ ছিল ৩৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এরপর এমন একটি বছরও বাদ যায়নি যে বছর তাদের ঋণ শতকরা হারে কমেছে। কীভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে, তার একটা নমুনা দেখা যাক ২০২১ সাল থেকে।

ওই বছর চীনের জিডিপির তুলনায় ঋণ ছিল ৭১ শতাংশের কিছুটা বেশি। পরের বছর তা হয় ৭৭ শতাংশ, তার পরের বছর ছাড়ায় ৮৩ শতাংশ। ২০২৪ সাল শেষে এই ঋণ আরও বেড়ে হবে ৮৮ শতাংশ। ঋণের যে প্রক্ষেপণ করা আছে, তাতে ২০২৯ সালে জিডিপির তুলনায় ঋণ দাঁড়াবে ১১০ শতাংশ।

২০২৩ সাল শেষে চীন সরকারের ঋণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৫৮০ বিলিয়ন ডলার।

মজার বিষয় হল অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সরকারে আসার পর অর্থনীতি নিয়ে যে কথা বলেছিলেন, প্রথম আলো প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর তা উল্টে গেছে।

গত ১৩ আগস্ট সচিবালয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদেরকে তিনি বলেন, “বৈদেশিক ঋণের স্থিতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও ‘কমফোর্টেবল’ অবস্থানে আছে।”

তিনি আরও বলেন, “বাইরের থেকে অনেকেই বলে কিছুই নাই, এত খারাপ অবস্থা না। লোনের টাকা পরিশোধ করতে পারব না, এতটা খারাপ অবস্থা না।”

তবে এক সপ্তাহ পর পুরো উল্টে গেছে তার বক্তব্য। চীনের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা শেষে ২০ আগস্ট সেই সালেহ উদ্দিনই সরকারের ঋণ নিয়ে বলেন, “ওটা বড় প্রেশার, প্রচণ্ড প্রেশার। কারণ এগুলো দিয়েছে ওরা চুক্তি করে। ডোনারদেরকে বলতে হবে এটা বিরাট প্রেশার। আমরা এগুলো রিভিউ করছি, দেখছি। আমরা এটা নিয়ে সতর্ক আছি। আমাদের নিজেদের মধ্যেও এটা নিয়ে কথা হচ্ছে। এত বড় ঋণের বোঝা নিয়ে শুরু করেছি, আমাদের জন্য খুব কঠিন। এগুলো আমরা সমাধানের চেষ্টা করব।”

আসলে অর্থনীতিকে বলা হয় রাজনীতির ঘনীভূত রূপ। তাই বলে এক সপ্তাহের মধ্যে একই অঙ্গে দুই রূপ দেখাবেন সালেহউদ্দিন আহমেদ?

এসব বিষয়ে অবশ্য এখন বাংলাদেশে প্রশ্ন তোলা কঠিন। নানা সময় নানা তালিকা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ছে, কে কে চাকরি করতে পারবে না, তা জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, মানে এখন ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কোনো বয়ান চলবে না, অথচ এত বছর ‘ফ্যাসিবাদ’, ‘ফ্যাসিবাদ’, সুর তোলা হয়েছে, আইন-সংবিধানের তোয়াক্কা না করে যা খুশি তাই করা হচ্ছে।

সরকার এক কলমের খোঁচায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে দিচ্ছে, তখন আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীরাই বা কম যাবে কেন? এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি সরকারি অফিসে এক কর্মকর্তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে তার ড্রয়ারে সিগারেটের প্যাকেট পাওয়া গেছে- এই কারণে।

ভদ্রলোক ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলেন এবং যারা তার অফিসে গিয়েছিলেন, তারা অবশ্য দয়াপরশ হয়ে পানি খাইয়েছেন। এখন ভদ্রলোক হাসপাতালে ভর্তি।

Related posts

বরিশালে সাম্প্রদায়িক হামলায় ভিটেমাটি ছাড়া অনেকে

Ny Bangla

বন্যায় চাপ তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে

Ny Bangla

ভাষণ রেকর্ড করে দেশত্যাগ করতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা

Ny Bangla

শেখ পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা বাতিল

Ny Bangla

স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ঐক্য ধরে রাখতে হবে: জামায়াতে আমীর

Ny Bangla

বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ‘মার্চ ফর জাস্টিস’

Ny Bangla

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Privacy & Cookies Policy